২৩ নাবিককে ঘিরে অনিশ্চয়তা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ মার্চ ২০২৪, ৯:৫১:০২ অপরাহ্ন
সোমালিয়ার দিকে নিয়ে গেলো জলদস্যুরা
জালালাবাদ রিপোর্ট : “ওরা বন্দুক নিয়ে আমাদের ঘেরাও করে ফেলেছে। আমরা সবাই জিম্মি। আমাদের সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর হয়তো তোমাদের সাথে কথা হবে না।” মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুরা দখলে নেয়ার সময় বাংলাদেশি কোম্পানির মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান কথাগুলো বলছিলেন তার মা শাহানুর বেগমের কাছে।
বুধবার সকালে বিবিসি বাংলার কাছে এসব কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। এসময় তিনি বলেন, “তার সাথে যখন কথা বলি তখনও তার ফোন খোলা ছিল। আমরা তখন ইফতার করছিলাম।”ইফতারের পাঁচ মিনিট পরে আতিকুল্লাহ খান একটি ভয়েজ এসএমএস পাঠান তার স্ত্রীর কাছে। যেখানে তিনি বলেন, “আমাদের ফোন নিয়ে ফেলতেছে মনে হয়। দোয়া কইরো। ফোন নিয়ে যাচ্ছে।”বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেকেই তাদের পরিবার কিংবা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সাথে হোয়াটসঅ্যাপের ফোন কিংবা ভয়েজ এসএমএস’র মাধ্যমে যোগাযোগ করেন।
কিন্তু সন্ধ্যার পর আর যোগাযোগ করতে পারেনি তারা। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ওই জলদস্যুরা সবার ফোন কেড়ে নেয়।জাহাজটি এখন কোথায় আছে আর কেমন আছে জিম্মি ২৩ নাবিক? এ বিষয়ে মালিকানা প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম’র মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একটি গোপন ডিভাইসের মাধ্যমে আমরা গভীর রাতে একজন জিম্মি নাবিকের সাথে কথা বলেছি। তারা সবাই সুস্থ আছে। এখনো কোনো ধরনের মুক্তিপণ দাবি করেনি।”নাবিকরা জিম্মি হওয়ার পর থেকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়ছে পরিবারে। এই অবস্থা থেকে তারা কবে মুক্তি পাবে জানতে পরিবার ভিড় করছে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে কেএসআরএম’র অফিসের সামনে।
এমন পরিস্থিতিতে বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “জাহাজটি এখনো জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণেই আছে। ২৩ জন জিম্মি নাবিকের জীবন রক্ষা করে নিরাপদে নিয়ে আসা আমাদের প্রথম কাজ। আমরা সেই কাজটি করার চেষ্টা করছি।”দখলে নেয়ার পর গতকাল সন্ধ্যা থেকে জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো জলদস্যুরা।
বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদপ্তরে মহাপরিচালক কমোডোর এম মাকসুদ আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে বতর্মানে ৪৮০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বে অবস্থান করছে জাহাজটি। গতিপথ দেখে মনে হচ্ছে জলদস্যুরা এটিকে সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।”
ফাঁকা গুলি ও ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ নেয় দস্যুরা :
মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টায় জাহাজটিতে ওঠে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। এ সময় জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা ছিল। এই জাহাজে থাকা ২৩ নাবিকের সবাই বাংলাদেশি।
জলদস্যুরা জাহাজটি দখলে নেয়ার পর জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের চেষ্টা করেন। পুরো পরিস্থিতি বর্ণনা করে জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠানকে গোপনে একটি অডিও বার্তাও পাঠান।
ওই অডিও বার্তাটি এসেছে বিবিসি বাংলার হাতে। তিন মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের সেই অডিও বার্তায় জাহাজটি নিয়ন্ত্রণ ও দখলে নেয়ার পুরো ঘটনার একটা ধারণা পাওয়া যায়।অডিও বার্তায় আতিকুল্লাহ খান বলছিলেন, “সকালে জাহাজের সময় আনুমানিক সাড়ে দশটায়, জিএমটি ৭.৩০মিনিটের সময় একটি হাইস্পিড স্পিডবোট আমাদের দিকে আসছিলো। তখন সাথে সাথে অ্যালার্ম দিলাম। আমরা সবাই ব্রিজের দিকে গেলাম।”
“তখন ক্যাপ্টেন আর সেকেন্ড অফিসার ব্রিজে ছিল। আমরা ঝিকঝাক কোর্স করলাম। তারপর এএমএস-এ করলাম। ইউকে এমটিকেও ট্রাই করলাম। কিন্তু তারা ফোন রিসিভ করেনি। এর মধ্যে জলদস্যুরা চলে আসলো।”
অডিও বার্তায় তিনি জানান, “চলে আসার পর ওরা ক্যাপ্টেন স্যার ও সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে। আমাদের ডাকলো। আমরা সবাই আসলাম। আমাদের ডেকে কিছু ফাঁকা গুলি করলো। আমরা একটু ভয় পেয়েছি। সবাই ব্রিজে বসে ছিলাম। কারো গায়ে হাত তোলেনি। শুধু সেকেন্ড অফিসারকে একটু মারধর করেছে। তারপর আরেকটি স্পিডবোটে করে আরও কয়েকজন চলে আসলো। এভাবে একটু সময়ের মধ্যেই প্রায় ১৫-২০ জন চলে আসে।”
“এর কিছুক্ষণ পরে একটি বড় ফিশিং বোট আসলো। এটা ছিল একটা ইরানিয়ান ফিশিং বোট। এই বোটটি নাকি তারা আরও একমাস আগে ক্যাপচার করেছিলো। তারা এটাতেই ছিল। এটি দিয়ে তারা এক মাস ধরে নতুন কোনো জাহাজ খুঁজতেছিলো। আনফরচুনেটলি ওরা আমাদের জাহাজে আসলো।”
চিফ অফিসার মোহাম্মদ আতিকুল্লাহ খান অডিও বার্তায় আরও বলেন, “এই ফিশিং বোটের তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন আমাদের জাহাজ থেকে ওরা ডিজেল নিচ্ছে। আমরা আমাদের পাম্প থেকে ওদের ডিজেল দিচ্ছি। এছাড়া ওদের কোনো নেয়ার সিস্টেম নাই। তারপর ওরা জাহাজ স্টপ করালো। এরপর সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার, থার্ড ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে ইঞ্জিন রুমে গেলো।তারপর জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। এখন পর্যন্ত জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এবং আল্লাহর রহমতে আমাদেরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে সবাই একটু ভয় পাচ্ছে। ওরা ভয় দেখাচ্ছে।”