আবাসস্থল সংকটে হারিয়ে যাচ্ছে পাথারিয়ার বন্যপ্রাণি ॥ হুমকিতে পরিবেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২৪, ৭:২২:২০ অপরাহ্ন
আব্দুর রব, বড়লেখা : সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলায় অবস্থিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তরেখার মধ্যবর্তী চারটি বনবিট নিয়ে গঠিত এই বনভূমি অবৈধ দখল করে জনবসতি স্থাপনে গত অর্ধশত বছরে পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের আয়তন ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৩৫ বর্গকিলোমিটারে। যা বন্যপ্রাণি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক অসনি সংকেত। আবাসস্থল সংকটে ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে এই বনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি। নানা প্রতিকুলতার মধ্যে এখনও টিকে আছে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণি। এগুলোও খাবার সংকটে বন ছেড়ে ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। বনাঞ্চল রক্ষা ও বন্যপ্রাণির আবাস্থল নিরাপদ রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে নিকট ভবিষ্যতে এগুলোও হারিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। ফলে আমাদেরও কঠিন বিপর্যয়ের মুখোমূখি হতে হবে।
ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র হটস্পটের মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চল পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্টের পূর্ব দিকে ভারতের করিমগঞ্জ, উত্তরে শাহবাজপুর আর দক্ষিণ ও পশ্চিমে চা-বাগান। পাহাড়ের মাঝে মাঝে কিছু মানুষের বসতি। পাথারিয়া হিলস্ রিজার্ভ ফরেস্ট নামটি অনেকের কাছে পরিচিত নয়। কিন্তু মাধবকু- জলপ্রপাতের কথা কমবেশি দেশের ছোট বড় সবাই জানে। এই মাধবকু- জলপ্রপাত পাথারিয়া পাহাড়ে অবস্থিত। পরিবেশগত ভাবে মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলের এ অংশটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র হটস্পটের অংশ।
এই বনকে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯২০ সালে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সালে পাথারিয়া পাহাড়ের আয়তন ছিল ১ হাজার ১৫২ বর্গকিলোমিটার। ক্রমশ মানুষের বসতি বেড়ে এই বনের আয়তন দিন দিন কমছে। বর্তমানে পাথারিয়া পাহাড়ের সম্মিলিত আয়তন মাত্র ১৩৫ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৮৮ বর্গকিলোমিটার আর ৪৭ বর্গকিলোমিটার পড়েছে ভারত অংশে। এক সময় পাথারিয়া বনে বুনো মোষ, বাঘ, জলার হরিণ, গন্ডারসহ বড় আকারের অনেক বন্যপ্রাণির আবাসস্থল ছিল। গত দুই বছর আগে ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে এই বনে এশীয় হাতি, বিপন্ন ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু, হলদে গলা মারটেন, আসামি বানরসহ অনেক বিপন্ন প্রাণি দেখা গেছে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০০৭ সালে বনের সুরমা বাঁশমহাল এলাকায় চিতা বাঘের আক্রমণে একটি গরু মারা যায়। তখন গরুর মালিক ক্ষিপ্ত হয়ে মৃত গরুর শরীরে বিষটোপ দেন। সেই চিতাবাঘটি মৃত গরুর মাংস খেয়ে মারা যায়। বিষয়টি হঠাৎ মধু শিকারির দৃষ্টিগোচর হয়। তারপর লোকমুখে জানাজানি হলে বাঘটি দেখতে এলাকার উৎসুক মানুষ ভিড় জমায়। পরে বন বিভাগ বাঘটি তারা উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এর পর থেকে স্থানীয়দের চোখে বাঘ দেখা কিংবা বাঘে গরু ধরার এমন দৃশ্য আর কখনও চোখে পড়েনি।
নিবিড় পর্যবেক্ষণে সম্প্রতি এই বনে প্রায় ৩৮ প্রজাতির স্থন্যপায়ী প্রাণির অস্থিত্ত্ব পাওয়া গেছে। মাঝারি মাংসাশী প্রািণদের মধ্যে সোনালি বিড়াল ও মেছো বিড়ালের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এগুলো দেখে কিছু আনন্দিত হলেও চিতাবাঘ অথবা মেঘলা চিতার কোন অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয় মধু শিকারিরা জানান, বিগত ২০১৭-১৮ সালের দিকে ভারত থেকে একদল আদিবাসী শিকারি বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে পাখি, বানর, গুইসাপ, চশমাপরা ও মুখপোড়া হনুমান সহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণি শিকার করলেও তখন বন বিভাগ নিরব ভূমিকা পালন করে।সিলেট বিভাগের একমাত্র বন পাথারিয়ায় মাত্র চারটি মেয়ে বন্যহাতি জীবনের সাথে সংগ্রাম করে আজও এই বনে টিকে আছে। কখনও বনে তাদের তাজা পদচিহ্ন দেখে আমরা আবেগআপ্লুত হই। বুনো হাতিগুলো আজ মানুষের পৃথিবীতে দুই দেশের কাঁটাতারের বাধার সম্মুখীন। এই দলের একটি হাতি বৃদ্ধ হয়ে গেছে। খাবার হজম হয় না যেভাবে খায় সেভাবে পায়খানা করে। কিছুদিন আগে জামকান্দি এলাকার একটি সবজি বাগানে এই দৃশ্যটি দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, সব সময় এমন দেখা যায়। পুরুষ হাতি না পেলে খুব শিগ্রই হাতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে! হাতি গুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে এখনই পাথারিয়া পাহাড়ে একটি পুরুষ হাতি অবমুক্ত করা প্রয়োজন।
২০২২-২৩ সালে দেখা গেছে, অস্বাভাবিকভাবে বন্যপ্রাণিরা বন ছেড়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এতে মানুষের সাথে সংঘাতের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণিরা নিয়মিত মরছে। তাদের চিরচেনা প্রিয় আবাস্থল ছেড়ে লোকালয়ে আসার কারণ হিসেবে জানা গেছে বনের মূল ভূখন্ডে বন বিভাগের কৃত্রিম বনায়ন। এসব কারণে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। স্থানান্তরিত হতে গিয়ে বন্যপ্রাণিরা অস্থিত্ব হারাচ্ছে। বনের প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধস্থানে ২০২০ সনে একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল চারটি উল্লুকের পরিবার। কিন্তুু, বনায়নের কারণে বিভিন্ন ফলজ গাছ কাটা পড়ায় এবং লতাগুল্ম গুড়া কেটে ফেলার কারণে তাদের খাবারের সংকট দেখা দেয়। এসব কারণে বর্তমানে তারা হুমকির সম্মুখিন। সুরমা বাঁশমহালের বনায়নকৃত এই একালায় এখন আর কোন বন্যপ্রাণির দেখা মিলে না। ফল শূন্য আকাঁশমনি গাছ দিয়ে বনায়ন করায় বন্যপ্রাণির জীবন যাপন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বন্যপ্রাণি গবেষকদের মতে, এই বনের প্রাকৃতিক বনাঞ্চল যতটুকু এখনও টিকে আছে, সঠিকভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিলে এসব প্রাণিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মাধবছড়া ও লাঠিটিলা বিটের সীমান্তবর্তী প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের সঙ্গে সমনবাগের কিছু এলাকাজুড়ে এখনই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এ ছাড়া বন্যপ্রাণি শিকারি ও গাছ চোরাকারবারিদের দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াও সময়ের দাবি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বন্যপ্রাণি গবেষক ড. এমএ আজিজ বলেন, পাথারিয়া পাহাড়ে মানুষের আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। একে ছেড়ে দিতে হবে প্রকৃতির ওপর। এতে যে পাথারিয়া ধীরে ধীরে বিরল বন্যপ্রাণীর শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠবে, এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। অতীতে কতটুকু কী হয়েছে, সেদিকে তাকিয়ে আর লাভ নেই। আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে। পাথারিয়া পাহাড় রক্ষা করতে না পারলে প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে আমাদেরও কঠিন বিপর্যয়ের মুখোমূখি হতে হবে।