সুরমা যেন ময়লার ভাগাড়
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ মার্চ ২০২৪, ৪:০০:১৯ অপরাহ্ন
মুনশী ইকবাল :
সিলেটের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে সুরমা নদী। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এর রূপে মুগ্ধ হয়ে নাম দিয়েছিলেন নহরে আজরক। আরবিতে আজরক অর্থ নীল রং। আর নহরে আজরক অর্থ নীল রঙের নদী। এই নীল পানির নদীই আজকের সুরমা। ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে হজরত শাহজালাল র. এর সাথে দেখা করতে নহরে আজরক দিয়ে ইবনে বতুতা সিলেট আসেন।
আবহমান কাল ধরে এই নদীর সাথে মিতালী করে গড়ে উঠে এর তীরবর্তী জনপদগুলো। নদী তীরবর্তী জনপদগুলো গঞ্জ নামে পরিচিত। সুরমার তীরে গড়ে ওঠা জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, কোম্পানীগঞ্জ, দোয়ারাবাজর, ছাতক, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ ধর্মপাশা নামীয় এই গঞ্জগুলো আজও সেই সাক্ষ্য বহন করে আসছে। ভারতের মণিপুর পাহাড়ে মাও সংসাং থেকে উৎপত্তি হওয়া বরাক নদী থেকে সুরমার উৎপত্তি। ১শ ৪৯ কিলোমিটারের দেশের দীর্ঘতম এ নদীর সাথে বৃহত্তর সিলেটের প্রকৃতি ও জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। জনশ্রুতি আছে রাজা ক্ষেত্রপালের স্ত্রী সুরম্যা এর নাম থেকেই এ নদীর নাম সুরমা।
এক সময় এই নদীই ছিল সিলেটের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস। এ নদীতে মাছ ধরা হতো ঝাকিজাল, উড়াজাল, উথালজাল, হৈফাজাল, হাটজাল ও পেলুইনজালে। বড়ো বড়ো বাণিজ্যিক নৌকা পাল তুলে ছুটে যেতো এর বুক চিরে। সময়ের ভেলায় চড়ে সুরমার সেই রমরমা অবস্থা এখন আর নেই। চর জেগে, নাব্যতা হারিয়ে খরস্রোতা সুরমা এখন মৃতপ্রায়। সেই সাথে সুরমা যেন এখন পরিণত হয়েছে ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে!
অবহেলা, অনাদর, অব্যবস্থাপনা আর দখল দূষণে সেই সুরমা আজ অনেকটা অস্তিত্ব সংকটে। এক সময়ের ঐতিহ্য আর সভ্যতার প্রতীক সুরমা এখন যেন চেনা যায়না। জায়গায় জায়গার ময়লা আবর্জনার স্তুপ জমে আছে। লোকজন প্রস্রাব-পায়খানা করে দূষিত করছেন পরিবেশ। তাছাড়া রাতের আঁধারে ক্বীনব্রিজের উপর থেকেও ভ্যানে করে ময়লা এনে সরাসরি সুরমায় ফেলা হয় বলেও জানিয়েছেন অনেকে। দেখা গেছে কোনো কোনো জায়গায় নদী ছোটো নালার মতো অবশিষ্ট আছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে। এই পানিতেই আশপাশের অনেক নারী পুরুষ গোসল করছেন, বাচ্চাদেরও গোসল করাচ্ছেন।
সিলেট নগরীর মাছিমপুর থেকে কানিশাইল পর্যন্ত বেশ কয়েকটি স্থানে ময়লার পরিমাণ বেশি। সবচেয়ে বেশি অবস্থা খারাপ দেখা গেছে কাজিরবাজার পিঁয়াজ পট্টির পেছনে কাজিরবাজার ব্রিজের কাছে পাগলা ঘাট নামক স্থানে। এখানে দেখা গেছে নদীর উত্তর থেকে প্রায় দক্ষিণ পাড়ের কাছাকাছি নদী ভরাট হয়ে গেছে আবর্জনা ও ময়লায়। জমেছে অল্প চরও। এসব জায়গায় আবর্জনা পরিষ্কার হয়না বলে জানান স্থানীয়রা। তারা বলেন স্থানীয় লোকজন আর আশপাশের দোকানের আবর্জনা সরাসরি নদীর তীরে ফেলে দেওয়া হয়। যখন নদীতে পানি বাড়ে তখন তা ভেসে যায়, অন্য সময় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর বাইরে নিজস্ব উদ্যোগে মাঝেমধ্যে কিছু আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু সুরমার দায়িত্ব যাদের কাঁধে তারা নির্বিকার।
আবর্জনার মধ্যে বেশিভাগ পলিথিনের বড়ো ব্যাগ ও প্লাস্টিকের বোতল। এরবাইরে কাঠের টুকরা, কাগজ, নষ্ট হয়ে যাওয়া কার্টুনও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ছাগল, কুকুর এসব আবর্জনা নেড়ে চেড়ে খাবার খুঁজছে। ছড়াচ্ছে বিকট দুর্গন্ধ। তীর থেকে পানি নেমে গেছে অনেক নিচে। সেই পানিতে গিয়ে এসব আবর্জনা বাতাসে মিশছে। স্থানে স্থানে ভেসে বেড়াচ্ছে আগুনে পোড়া গন্ধ। মল-মূত্রের গন্ধে অনেকে নাক চেপে যাচ্ছেন।
কাজিরবাজার পাগলা ঘাটে একটি দোকানে কথা হয় ইদ্রীছ আলী নামে একজনের সাথে। তিনি বলেন, এখানে কোনো ‘পরিষ্কার টরিষ্কার’ হয়না। একটা লোক রাখা হয়েছে সে তার ইচ্ছেমতো মাঝেমধ্যে এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। যেদিন আসে সেদিন হাত পেতে টাকা নিয়ে যায়। এরবাইরে কোনো কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়না। কর্তৃপক্ষ কে বা কারা নদী দেখাশোনা করে তাও আমাদের জানা নেই।
দক্ষিণ সুরমার খোজারখলার ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির আকাশ বলেন, একসময় এই সুরমার কত নাম আমরা শুনেছি। ছোটোবেলা এই নদীর তীরে এসে বসে হাওয়া খেতাম। তখন আজকের মতো নদীর তীর এত সুন্দর ছিল না। নানান জনের আড্ডা ছিল। কিন্তু তবুও নদীতে প্রাণ ছিল। গরমে বিকেল বেলা এর তীরে এসে বসলে সুন্দর বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যেতো। কখনো কখনো বন্ধুবান্ধব মিলে নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি করতাম। কিন্তু এখন ঝাঁপাঝাঁপি কী করবো এর কাছেই ঘেষা যায় না। কোথাও কোথাও এত বিকট দুর্গন্ধ বমি চলে আসে। আর নদীর পানি ব্যবহার করলে সাক্ষাত চর্মরোগ হয়ে যাবে। তিনি বলেন নদীর তীর যেমন সুন্দর করা হয়েছে তেমনি নদীও দখল মুক্ত করা এর তীর আবর্জনা মুক্ত রাখা জরুরি। যেভাবে নদী দখল আর দূষণ হচ্ছে এতে অদূর ভবিষ্যতে এই নদী বাঁচানোই দায় হবে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদী দূষণের এই মাত্রা বন্ধ করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কঠোর হতে হবে। যারা নদীতে আবর্জনা ফেলে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অপেক্ষাকৃত বেশি দূষণযুক্ত জায়গাগুলো চিহ্নিত করে নজরদারী করতে হবে। প্রত্যেক কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম দৈনিক জালালাবাদকে জানান, নদী তীরবর্তী আবর্জনা পরিষ্কার নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। যারা নদীতে আবর্জনা ফেলে তাদের চিহ্নিত করে জরিমানা করা সহ তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যেসব জায়গায় ময়লা বেশি জমে গেছে তা তড়িৎ পরিষ্কারের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এসব জায়গায় সিসি ক্যামেরারর মাধ্যমে নজরদারি করতে হবে। তাছাড়া নদী তীরবর্তী মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা চালাতে হবে, প্রয়োজনে পরিবেশবাদীদের সহায়তা নিতে হবে। তাছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সিটি কর্পোরেশনের কাছে নদী দূষণের ব্যাপারে জবাবদিহি চাইতে পারে। তিনি বলেন ভ্যানে করে ময়লা এনে ক্বীনব্রিজ থেকে সরাসরি সুরমা নদীতে ফেলা হয়। এটা বন্ধ করতে সিসিককে কঠোর হতে হবে।