ফায়ার সার্ভিস : অন্তহীন কাজ থাকলেও নেই আইনী ক্ষমতা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২৪, ৯:৩৫:৪১ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ কোনো ভবনের অভিযোগ পেলে নোটিশ পাঠানো ছাড়া অন্য কোনো কাজ থাকে না ফায়ার সার্ভিসের। তাদের জন্য আলাদাভাবে আইন থাকলেও সেখানে কোনো ধরনের জরিমানা বা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়নি। এতে করে কোনো ভবনে অগ্নিঝুঁকি বা অনিয়ম থাকার পরও কিছুই করার থাকে না সংস্থাটির।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অগ্নিকা-ের ঘটনা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেই সব ভবনে নোটিস পাঠালেও তাদের সক্ষমতার অভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ফলে ভবন মালিকরা বিষয়টিকে অবহেলা করে অগ্নিনিরাপত্তা গ্রহণ করেনি।ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, তাদের নির্দিষ্ট কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেই। ফলে তাদেরকে জেলা অফিস ও সিটি কর্পোরেশন বরাবর আবেদন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চাইতে হয়। কারণ কোনো অভিযান পরিচালনার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে রাখতে হয়। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বারবার নোটিশ পাঠালেও তার ভ্রুক্ষেপ করেন না ভবন মালিকরা। যদি ফায়াস সর্ভিসের জরিমানা ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা থাকত তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসতো বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
ফায়ার সার্ভিসের সূত্রে জানা যায়, রাজধানীসহ দেশজুড়ে ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে ২ হাজার ৫১২টি ভবন। এগুলোকে অনেকে অগ্নিবোমা হিসেবে অভিহিত করেছেন। এসব ভবনে ফায়ার সার্ভিস থেকে নোটিস পাঠালেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এসব ভবনের মধ্যে শুধু মার্কেট ও শপিংমল রয়েছে এক হাজার ৪৮টি। বাকিগুলো হলো বিভিন্ন হাসপাতাল, আবাসিক হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া হাউস। এই সব প্রতিষ্ঠানকে বারবার নোটিস দিলেও আইনি পদক্ষেপ না নেয়ায় সচেতন হচ্ছে না।
জানা যায়, ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপণের গাড়িটির প্রস্থ ৮ দশমিক ৪ ফুট ও দৈর্ঘ্য হলো ৩৫ দশমিক ৮ ফুট। জরুরি অপারেশনের মুহূর্তে এটি ২০ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত হয়ে থাকে। এর ফলে ঢাকার রাস্তাগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। বিশেষ করে জাম্বু কোশনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় সেটি ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটছে।
বিভিন্ন ভবন পরিদর্শন করে দেখা যায়, প্রতিটি ভবনে আলাদাভাবে জরুরি মুহূর্তের জন্য সংরক্ষিত পানির ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ ভবনেই নেই সেই ব্যবস্থা। রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী, ছয়তলা উপরে কোনো ভবন হলে সেটি বহুতল ভবন হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে সেখানে দুটি সিঁড়ি থাকা বাধ্যতামূলক। তাবে অধিকাংশ ভবনই মানছে না সেই আদেশ। ফায়ার সার্ভিসের পানির চাপ সাধারণত ছয়তলা পর্যন্ত উঠতে পারে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো ভবন পরিদর্শন শেষে ঝুঁকিপূর্ণ ও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দেয়া হয়। কোনো কোনো জনসমাগম মার্কেট বা শপিংমলের সামনে নোটিসও টানিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি ভবনগুলো যে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ, তা জানিয়ে রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে নোটিসের অনুলিপি দেয়া হয়। কিন্তু আইনি ব্যবস্থা না থাকায় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না। এতে করে বারবার নোটিস দিয়েও কাজ হচ্ছে না। অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ এ ফায়ার সার্ভিসকে মামলা, জরিমানা ও তল্লাশি করার মতো ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে ওই আইনের বিধিমালা স্থগিত থাকায় তারা তা প্রয়োগ করতে পারছেন না। এ কারণে নোটিস দেয়া ছাড়া তাদের করার কিছু থাকে না।
জানা যায়, নোটিস দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হলেও সিটি কর্পোরেশন, রাজউক ও সরকারি সংস্থার সাথে আতাত করে এসব ভবনে চলে অবৈধ কার্যক্রম। তা ছাড়া আবাসিক অনুমোদিত ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও রেস্তোরাঁ ব্যবসা চলছে রমরমা। জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেন, রাজউক বা সিটি কর্পোরেশনের অনুমতিক্রমেই বাণিজ্যিক ও রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে। তবে এসব সংস্থা বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে ফায়ার অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, নোটিশ দেয়ার বাইরে তাদের আর ক্ষমতা নেই। এ জন্য যাদের এনফোর্সমেন্ট ক্ষমতা রয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোকে তারা নোটিসের অনুলিপি দিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করে থাকেন।
ফায়ার সার্ভিসের আইনি প্রয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট মফিজুর রহমান মোস্তাফিজ বলেন, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ এর অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসের ক্ষমতা থাকলেও বাস্তবে তা প্রয়োগ হয় না। বিধিমালা-২০১৪ এর বিধি ২২ মোতাবেক কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে তাহলে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিধিমালা-২০১৪ এর বিধি ২০ অনুযায়ী মামলা দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। সে অনুযায়ী কোর্ট তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিতে পারে, যেমন ছয় মাস তিন বছর ও সাত বছর দ- দেয়ার ক্ষমতা আছে।
তিনি আরও বলেন, এই আইনের সমস্যা হলো কোনো ব্যক্তি আইন লঙ্ঘন করলে মামলা করতে হলে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকের অনুমোদন ব্যতীত মামলা করতে পারবে না। অনেক আইনে বলা হয়েছে, সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া মামলা হবে না। এ ধরনের আইনে একটি জটিলতা থেকেই যায়। তাদের যে ক্ষমতা আছে সে অনুযায়ী প্রয়োগ নেই।
ফায়ার সার্ভিসের জরিমান ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জনাতে চাইলে ফায়াস সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘আমরা জরিমানা করতে পারি তবে এটি সরাসরি নয়। এ ক্ষেত্রে জেলা অফিস বা সিটি কর্পোরেশনের কাছে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য আবেদন করে তারপর জরিমানা করতে হয়। আমাদের শুধু নোটিস দিয়েই থেমে থাকতে হয়। তবে মাঝে মধ্যে চিঠি দিয়েও কাজ না হলে মোবাইল কোর্ট চালানো হয়। পুলিশ যেমন অপরাধীকে যেকোনো মুহূর্তে জরিমানা বা গ্রেপ্তার করতে পারে। আমাদের আইনে সে ধরনের ব্যবস্থা নেই। অগ্নিবিধিমালা-২০০৩ সালের আইনে জরিমানা বা গ্রেপ্তার অথবা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো সক্ষমতা দেয়া হয়নি। আইনে যদি ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা থাকতো তাহলে মানুষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতো বাধ্য হতো। সেই সক্ষমতা না থাকায় সব সময় পদক্ষেপ নিতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে যথাসময়ে আগুন লাগার খবরটি দেয়া হয়নি। প্রথমে কর্তৃপক্ষ নেভানোর চেষ্টা করে ফলে অনেক দেরি হয়ে যায়। যে স্থানে আগুন লাগে সেখানের রাস্তাগুলো সরু হওয়ার কারণে অগ্নিনির্বাপণ গাড়ি যেতে পারে না। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অধিকাংশ রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলতে পারে না। দুর্ঘটনার স্থানে উৎসুক জনতার কারণে কাজ করার অবস্থা থাকে না। শহরে বিভিন্ন কোম্পানির ডিশ ও ইন্টারনেটের তারের কারণে কাজ করতে বাধা সৃষ্টি হয়। রাজধানীর জন্য পানি খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলাধারার অভাবের কারণে আগুন নেভাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়।