দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি গাজা : নিহত ৩২ হাজার ছুঁই ছুঁই
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মার্চ ২০২৪, ৯:২০:২৭ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : গত ১১ মার্চ ভোর থেকে আরব বিশ্বে যখন মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাস শুরু হয়েছে, তখন গাজার বাসিন্দারা মুখোমুখি হয়েছেন এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার।
যে রমজান মাসে মুসলমানরা সারা দিন রোজা রাখেন, অর্থাৎ খাবার-পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকেন, সেটি গাজাবাসীর সামনে দুর্ভিক্ষ হয়ে এসেছে।
গত পাঁচ মাস ধরে যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন গাজার বাসিন্দারা। বাস্তবিক অর্থে এখনো সেখানকার সব মানুষ এখন খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করেই চেয়ে আছেন।
গাজার বাসিন্দা ৫৭ বছর বয়সী একজন মা নাদিয়া আবু নাহেল বলেন, গত রমজানের কথা মনে আছে, অনেক ভালো ভালো খাবার ছিল … শরবত, খেজুর, দুধ … আপনি যা খেতে চান, সব কিছুই ছিল। এই বছরের সাথে তুলনা করলে এটা যেন বেহেস্ত আর দোজখের পার্থক্যের মতো।
তিনি বলেন, শিশুরা রুটির একটা টুকরার জন্য আকাঙ্খা করে থাকে, এই খাবারটাও তাদের কাছে এখন স্বপ্নের মতো। তাদের হাড়গোড় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাদের মাথা ঘোরে, হাঁটতে কষ্ট হয়, সবাই শুকিয়ে যাচ্ছে।
গাজা উপকূলের বাসিন্দা ছয় সন্তানের পিতা খালেদ বলেন, গাজা উপত্যকায় আমাদের জন্য এখন যে অবস্থা, তাতে মৃতদেরকেও আমাদের হিংসা হয়। এই বছর আমরা আসলে রমজান মাসে নেই, আমাদের হয়তো এর নাম পরিবর্তন করা উচিত। আমরা এখন আছি মৃত্যু মাসের মধ্যে।’
গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের জরুরি বিভাগের উপ-পরিচালক ড. আমজাদ ইলেইয়া বলেন, এখানকার মানুষজন ইতোমধ্যেই মাসের পর মাস জুড়ে অনাহারে থাকছে। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সারা শহর জুড়ে তারা খাবার খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু কোথাও পায় না।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পাল্টা জবাব হিসাবে ইসরায়েলের বোমাবর্ষণের ফলে গাজার খাদ্যের সব অবকাঠামো আর ক্ষেতখামার ধ্বংস হয়ে গেছে।
সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, সরবরাহ ট্রাকগুলো ঘিরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর অতিরিক্ত তদারকির কারণে জনগণের কাছে সাহায্য পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে ।
বিশ্বে যে সংস্থাটি দুর্ভিক্ষের বিষয়ে ঘোষণা দিয়ে থাকে, সেই ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জানিয়েছে, ১১ লাখ মানুষ – যা গাজার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক – ইতোমধ্যেই অনাহারে থাকছে। বাকি যারা আছে, তারাও জুলাই মাস নাগাদ দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়বে।
খাদ্যের এই সংকট সবচেয়ে বেশি গাজার উত্তরাঞ্চলে। গত বছরের রমজানের মতো এবার আর তারা সেহরিতে পেট ভরে খেতে পারছেন না বা ইফতার করে ক্ষুধা মেটাতে পারছেন না।
রমজানে যেখানে সড়কগুলো নানাভাবে সজ্জিত থাকত, ড্রাম বাজত বা উদযাপনের নানা আয়োজনে ভরে থাকত, সেখানে এখন ধ্বংস, মৃত্যু আর খাবার খোঁজার প্রতি দিনের লড়াই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
দাতব্য সংস্থা পভার্টি চ্যারিটি কেয়ারের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে উত্তর গাজা এলাকায় অপুষ্টি বা পানিশূন্যতায় অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৩টি শিশু রয়েছে। যদিও উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতে, এই সংখ্যা আরও বেশি বেশি হবে।
আল-শিফা হাসপাতালে অপুষ্টিতে ভোগা যে শিশুদের এই রমজান মাসে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে একটি শিশু ছিল ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।
আরেকটি দুগ্ধপোষ্য শিশুর বয়স ছিল মাত্র চার মাস, যার মা কিছুদিন আগে মারা গেছে, কিন্তু এখন তাকে দুধ কিনে দেওয়ার মতো কেউ নেই। ১৮ বছর বয়সী আরেকটি মেয়ে রয়েছে, যে এর মধ্যেই মৃগী রোগে ভুগতে শুরু করেছে।
আল-শিফা হাসপাতালের চিকিৎসকরা অপুষ্টিতে ভোগা অনেক শিশুকে আরও উত্তরের হাসপাতাল কামাল আদওয়ানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও শিশুদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি।
কামাল আদওয়ান হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ড. হুশাম আবু সাফিয়া জানিয়েছেন, গত চার সপ্তাহের মধ্যে অপুষ্টি বা পানিশূন্যতার কারণে হাসপাতালে ২১টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এখনও সেখানে ১০টি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এসব শিশুকে রক্ষা করতে না পেরে নিজেকে আমার অসহায় লাগে। এটা কষ্টকর আর লজ্জাজনকও,’’ বলছেন ড. সাফিয়া। তিি বলেন, আমার সহকর্মীদের জন্যও আমার একই রকম অনুভূতি হয়, যারা নিজেরাও ঠিক মতো খেতে পায় না। অনেক দিন তাদের খালি পেটেই কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, ‘’ইসরায়েল একটি ‘অনাহারের যুদ্ধ’ শুরু করেছে।’’
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র আবির ইতেফা বলেছেন, “তথ্যপ্রমাণেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আইপিসির পঞ্চম দফার কর্মসূচির অধীনে ১১ লাখ শিশু তালিকাভুক্ত রয়েছে – এর মানে হচ্ছে সেখানে বিপর্যয়কর খাদ্য সংকট চলছে। সেখানে থাকা দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি শিশু তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মানে তারা মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলি হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় আরও ১০৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে গত ৭ অক্টোবর থেকে অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলায় ৩১ হাজার ৯২৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ফিলিস্তিনিদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।