১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল বাংলাদেশের ঋণ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ মার্চ ২০২৪, ১২:৩০:৫৭ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ২০২৩ সাল শেষে ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) ডলারের বেশি ছাড়িয়েছে। ১৫ বছর আগে ২০০৮ সাল শেষে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে দেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৭৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৪২ শতাংশ।বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি ঋণের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, বিদেশি ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের আরও সতকর্তা অবলম্বন করার দরকার ছিল। কারণ সক্ষমতা অনুযায়ী সবসময় বিদেশি ঋণ নিতে হয়। বর্তমানে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ রয়েছে, তা পরিশোধে সরকার চাপে পড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছর ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ ২০০৮ সাল শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতের ঋণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের ছিল ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৩৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এর মধ্যে ২০০৯ সাল শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১০ সালে ২৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন, ২০১১ সালে ২৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ও ২০১২ সালে ২৭ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।
২০১৩ সালে এ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। ওই পাঁচ বছরে সরকারি খাতে ৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার বেড়ে বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। আর বেসরকারি খাতের ঋণ ২ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার।
ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে বিদেশি ঋণ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন বাড়লেও, ২০১০ সালে তা প্রায় ৮৩৬ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পায়। তবে পরের বছর তা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বাড়ে। যদিও ২০১২ ও ২০১৩ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার করে।
তবে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল এই পাঁচ বছরে বৈদেশিক ঋণ নেয়ার হার বৃদ্ধি পায়। ওই পাঁচ বছরে বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৭৯ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সাল শেষে বিদেশি ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন, ২০১৬ সালে ৪১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন, ২০১৫ সালে ৩৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন এবং ২০১৪ সালে ৩৭ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ পাঁচ বছরে বিদেশি ঋণ বাড়ে ২৫ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার।
ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালেই বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পায় ৫ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তবে পরের বছর তা মাত্র ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার বাড়ে। ২০১৬ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে রেকর্ড ৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ও ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে গত ১৫ বছরের মধ্যে শেষে ৫ বছরে (২০১৯-২০২৩ সাল) সর্বোচ্চ বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পায়। এ সময় বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৬ শতাংশের বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল প্রায় ৬৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৭২ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে ৯০ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ও ২০২২ সালে ৯৬ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সাল শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। এ পাঁচ বছরে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার ও বেসরকারি খাতের বেড়েছে ৮ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। গত পাঁচ বছরে বিদেশি ঋণ সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে বাড়ে ৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে ৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন, ২০২১ সালে রেকর্ড ১৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন, ২০২২ সালে ৫ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ও ২০২৩ সালে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ ২০২১ সালে বিদেশি ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে শুধু সরকারি ঋণ বৃদ্ধি পায় ৯ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন আর বেসরকারি ঋণ বাড়ে ৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী বছর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা ছিল। তখন বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক কমে যায়। ওই সময়ে ডলারের চাহিদাও কমে। এতে অনেক দেশ তখন ঋণ পরিশোধ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে উল্টোটি। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তার মাধ্যমে ঋণের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। ঋণ পরিশোধের শর্ত শিথিল করে। কম সুদ এবং সহজ শর্তের কারণে ব্যবসায়ীরাও বিদেশ থেকে প্রচুর ঋণ নিতে থাকেন। ফলে ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ বৃদ্ধি পায়।
অপরদিকে ২০২২ ও ২০২৩ সালে ঋণ বৃদ্ধির হার কমার অন্যতম কারণ ছিল ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি। এছাড়া বিশ্বব্যাপী সুদহারও বাড়তে শুরু করে এ সময়। এতে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ নেয়ার পরিমাণ কমে এলেও পরিশোধ বৃদ্ধি পায়। তাই এই সময়ে ঋণের পরিমাণ কমেছে। এছাড়া গত দুই বছরে সরকারি খাতেও বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ এসেছে ২৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। তবে এ সময়ে ঋণ পরিশোধ করা হয় ৩০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর নিট স্বল্পমেয়াদি ঋণ শোধ করা হয়েছে চার দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছর বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমার ফলে এ খাতের ঋণের স্থিতিও কমেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে স্থিতি কমেছে ৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
বেসরকারি উদ্যোক্তারা বলছেন, গত বছরের শুরুতে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৫ টাকা। ডিসেম্বরের শেষে তা দাঁড়ায় ১০৭ টাকা। এর মানে, শুধু বিনিময় হার জনিত কারণে প্রতি ডলারে খরচ বেড়েছে ২২ টাকা। সুদহারও কয়েক গুণ বেড়েছে। ২০২১ সালের শুরুতে সবধরনের খরচসহ স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের সুদহার ছিল ৩ শতাংশের কম। এখন সেই ঋণে সুদ গুনতে হচ্ছে ৯ শতাংশের বেশি। আবার বিনিময় হার বা সুদহার এ পর্যায়ে স্থিতিশীল থাকবে কিনা তাও কেউ বলতে পারছে না। অভ্যন্তরীণ ঋণের তুলনায় বিদেশি ঋণের খরচ বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিদেশি ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এতে বিদেশি ঋণের প্রতি ঝোঁক কমে আসে।
এ ব্যাপারে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার গত কয়েক বছর অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের জন্য বিদেশি ঋণ নিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতেও বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়। এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। আবার পদ্মার রেলওয়ে, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় কিছু প্রকল্প এখনই দরকার ছিল না। কোনো প্রকার স্টাডি ছাড়া হঠাৎ করেই এসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভবিষতে যেন বড় অপরিকল্পিত প্রকল্প না নেয়া হয়। যেকোনো বড় প্রকল্প নিলে ভেবেচিন্তে নিতে হবে। সস্তায় যদি জাপানিরা কোনো প্রকল্প করে দেয়, তা নেয়া যায়। তবে চীনের ঋণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তারা যদি সস্তায় ঋণ দেয়, তাহলে সেটাও নেয়া যাবে। তবে বর্তমানে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেয়া হয়েছে, তা পরিশোধে চাপে পড়বে দেশ। তাই আগামীতে কীভাবে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সাল শেষে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ ছিল ৭২ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেড়েছে সাত দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সাল শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ ছিল ২৪ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমেছে তিন দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। ফলে সার্বিকভাবে গত বছর বিদেশি ঋণ বেড়েছে চার দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।