অ্যাপে নয় খ্যাপেই আগ্রহ : বাড়ছে নিরাপত্তাঝুঁকি
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মার্চ ২০২৪, ৪:১৮:০০ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : উন্নয়ন কর্মকান্ড ঘিরে নগরীতে বাড়ছে যানজট। এমন পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট সময়ে কাংখিত গন্তব্যে পৌঁছতে অনেকের ভরসা ভাড়ায় চলা মোটরসাইকেল। নগরীর ফুটপাত ও রাস্তা থেকে হকার উচ্ছেদের কারণে ফাঁকা রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে বসে থাকতে দেখা গেছে বাইকারদের। তবে ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছে বিপত্তি। অ্যাপে ভাড়া নির্দিষ্ট করা থাকলেও চুক্তিতে অতিরিক্ত ভাড়ায় চলতে হচ্ছে যাত্রী সাধারণকে। অ্যাপে না চলে চুক্তিতে চলাচলে যাত্রী ও চালক উভয়ের নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েছে। চুক্তিতে চলাচলকারী মোটরসাইকেলে ছিনতাই, হয়রানি থেকে শুরু করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। তবে এটাকে খুব বেশি আমলে নিচ্ছেন না মোটরসাইকেল চালকেরা।
যাতায়াতের ভোগান্তির এই নগরে অ্যাপচালিত মোটরসাইকেল সেবাও কার্যত নষ্ট হয়ে গেল তিন বছর যেতে না যেতেই। ভাড়া নিয়ে সিএনজিতে যে যাত্রী হয়রানি সেই একই চিত্র এখন মোটরসাইকেল ভাড়ায়। অ্যাপে মোটরসাইকেল ভাড়ার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। বলা হচ্ছিল, যাত্রীর ইচ্ছামতো গন্তব্যে যাবেন চালকরা, ভাড়া ঠিক হবে অনলাইনেই। কিন্তু ‘পোষায় না’ অযুহাতে চালকরা শুরু করছেন জোচ্চুরি।
শুরুতে অ্যাপে যত ভাড়া আসে সেটা দেখে নিয়ে সেই ভাড়াতে অ্যাপ ছাড়া যাত্রীদের যেতে প্রস্তাব দিতেন বাইকারদের কেউ কেউ। এখন আর সেসবের ধারও তারা ধারছেন না। অনলাইনে রিকোয়েস্ট পাঠালে কল রিসিভ করেন না চালকদের বড় অংশ। যাত্রীরা কল করলেও শুনতে হচ্ছে, ‘যাব না’, ‘অ্যাপে না, খ্যাপে যাব’।
মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে লোকাল বাসের সহকারীদের মতো যাত্রীর জন্য ডাকাডাকি করতে দেখা যায় দিনরাত। ‘কই যাবেন’, ‘যাবেন নাকি’- এই শব্দগুলো শুনে প্রায়শই বিরক্তি প্রকাশ করেন পথচারীরা।
ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়ায় চরম ভোগান্তির মধ্যে ২০১৬ সালে প্রথম অ্যাপের বাইক সেবা আনে স্যাম। এরপর একে একে আসে উবার, পাঠাওসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।
তবে ওই বছরের শেষ দিকে অ্যাপভিত্তিক গাড়ি ভাড়া সেবা পাঠাও মোটরসাইকেল এবং পরে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান উবার প্রাইভেট কার ভাড়ার সুবিধা নিয়ে আসে। মুহূর্তেই তুমুল জনপ্রিয় হয় দুটি সেবাই। পরে দুটি অ্যাপেই মোটরসাইকেল ও গাড়ি ভাড়া সেবা চালু করে। একে একে চালু হয় ‘সহজ’, ‘ও ভাই’, ‘ইজি অ্যাপ’সহ আরও ১৪টি কোম্পানি। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে অ্যাপে গাড়ি ভাড়া সেবা কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়। কথা ছিল, এরপর নীতিমালার বাইরে গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
নগরীর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গেইটের সামনে বুধবার রাত ৯টার দিকে বেশ কয়েকটি বাইকের জটলা দেখা যায়। পথচারী এলেই রিকশাওয়ালাদের পাশাপাশি হাতে হেলমেট নিয়ে বাইক চালকদেরও ‘যাবেন নাকি’, ‘কই যাবেন’, ডাকতে দেখা যায়। হেঁটে যাওয়া নারী যাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখান।
বিরক্ত এক নারী বলেন, ‘এক সময় বাইকার দেখলে আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করত। চালকদের প্রতিও এক শ্রদ্ধা কাজ করত। আর এখন তো প্রায় প্রত্যেকটা মোড়েই এরা এমনভাবে ডাকে, কে রিকশাওয়ালা আর কে বাইকওয়ালা বোঝার উপায় নাই।’
এক বাইকারের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়াতে দেখা গেল একজনকে। অ্যাপে ওই যাত্রীর রিকোয়েস্ট গ্রহণ করলেও ফোন দেননি বাইকার। যাত্রী নিজেই বেশ কয়েকবার কল দেন। হাসপাতালে তার বোন ভর্তি। যেতে হবে দ্রুত, কিন্তু ওই চালক অ্যাকসেপ্ট করার পর তা ক্যানসেলও করছেন না, ফলে নতুন করে রিকোয়েস্ট পাঠাতেও পারছেন না ওই যাত্রী। পরে মোড়ে এসে পেয়ে যান বাইকারকে। শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। একপর্যায়ে পাশের তিন-চারজন তাদের বাইকে চুক্তিতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এতে আরও বিরক্ত হন ওই যাত্রী।
যাত্রীর নাম মিজান। তিনি বলেন, ‘ওরা এভাবে ডাকতে পারে না। এটার কোনো নিয়ম নাই। তাদের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই যাব না। কারণ, নিরাপত্তার একটা ব্যাপার। অ্যাপে গেলে সব রেকর্ড থাকে। কিন্তু তারা যে ছিনতাই করবে না, তার নিশ্চয়তা কী?’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাইক অ্যাপে চালালে যে আয় খুব কম হয়, তা নয়। তবে মোট আয়ের ২০ শতাংশ কোম্পানিকে দিয়ে দিতে হয়। আর এটাকে অতিরিক্ত মনে করছেন বহু বাইকার। যদিও কোম্পানি থেকে বাইকাররা বোনাস পান। আর এতে বেশ ভালো আয় হতো বলে বাইক চালাতে আগ্রহ বাড়তে থাকে। আর শুরুতে প্রধানত অল্প আয়ের চাকরিজীবী বা ছাত্ররা বা শিক্ষিত বেকার বাড়তি আয়ের জন্য বাইক চালালেও পরে রাইডার হিসেবে নিবন্ধনের স্রোত তৈরি হয়।
ফুটপাতের হকার, শ্রমজীবী এমনকি সিলেটের বাইরে থেকে দলে দলে লোক এসে বাইকার হিসেবে নিবন্ধন করতে থাকে। এমনকি অটো চালানো বাদ দিয়েও বাইকে যাত্রী টানা শুরু হয়। আর এরা যাত্রী টানা শুরুর পর থেকেই সিএনজির ভোগান্তি ধীরে ধীরে আসতে থাকে বাইকেও।
গত কয়েকদিন ধরে বহুজনকে কল দিয়েও অ্যাপে নির্ধারিত ভাড়ায় যেতে রাজি করানো যায়নি। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তারা রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেন না, আর গ্রহণ করলেও কল দেন না, নিজেরা কল দিলেও তা রিসিভ করেন না।
মদীনা মার্কেট থেকে বন্দরবাজার যাবেন ফারুক। তিনি কয়েকবার চেষ্টা করার পর একজন বাইকার তার রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেন। কিন্তু তিনি কল করেননি ফারুককে। ফারুক একের পর এক কল করলেও তা রিসিভ করেননি বাইকার।
পথে আরেকজন বাইকার বললেন, ‘অ্যাপে না, খ্যাপে হলে যাব’। অ্যাপে রিকোয়েস্ট দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তাই ‘কত নেবেন’ জানতে চান ফারুক। আর ওই চালক দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের জন্য ভাড়া চাইলেন ১০০ টাকা। পরে বাধ্য হয়ে সিএনজি অটোরিক্সাতে চড়েন গন্তব্যে যান ফারুক। সেখানে গিয়ে দেখেন, তিনি যে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন, সেখান থেকে ভাড়া দেখানো হয়েছে ৮১ টাকা। অথচ তাকে শুরুতে সম্ভাব্য ভাড়া দেখানো হয়েছিল ৫০ টাকা।
অর্থাৎ ফারুকের রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে ওই বাইকার চুক্তিতে আরেকজন যাত্রী বহন করেছেন। কিন্তু অ্যাপ কোম্পানি জেনেছে তিনি অ্যাপের যাত্রী বহন করছেন।
আম্বরখানা পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকার মোজাম্মেল বলেন, ‘চুক্তিতে আগেই বেশি বলে নিই, যাতে ভাড়া নিয়া গ্যাঞ্জাম না লাগে। আবার মাঝে মইধ্যে অনেকক্ষণ ট্রিপ না পাইলে একটু বেশিই ভাড়া চাই। নাইলে তো পোষাবে না।’
সিটি পয়েন্ট, আম্বরখানা পয়েন্ট, জিন্দাবাজার পয়েন্ট, সুরমা মার্কেট পয়েন্ট রীতিমতো বাইক স্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। সেখানে যাত্রীর জন্য অপেক্ষায় থাকা মফিক বলেন, ‘একশ টাকার খ্যাপ মারলে কোম্পানি নিয়ে যায় ২০ টাকা। তেল খরচ হয় আরও ২০ টাকা। তাহলে আমাদেরতো কিছুই থাকে না।’
‘প্রায় এক বছর ধরে রাইড শেয়ার করছি। তবে গত তিন মাস হাতে গোনা কয়েকটা রাইড অ্যাপসে গেছি, আর বাকি বেশিরভাগ গেছি চুক্তিতে।’
সুরমা মার্কেট পয়েন্টে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা রফিক বলেন, ‘চুক্তিতেও নেই, আ্যাপেও যাই। এক কিলোমিটার বা দুই কিলোমিটার পথ গেলে অনেক সময় একশ টাকা বিল আসে। এত বেশি ভাড়া আসলে যাত্রীদের সঙ্গে হাতাহাতি হয়ে যায়। এই কারণে আ্যপে যেতে চাই না। অনেকে মনে করে চুক্তিতে বেশি ভাড়ার জন্য যাই, এটা কিন্তু ঠিক না।’
অপরিচিত যাত্রীদের এভাবে ডেকে নিয়ে বাইকাররাও কি নিরাপত্তাহীনতায় পড়ছেন না?- জবাবে সাহেদ মিয়া নামে এক বাইকার বলেন, ‘সিলেট শহরে এমন হয় না। আর আমি তো মেইন রোডেই থাকি। গলিতে যাই না।’
কিন্তু আপনাদের তো অ্যাপে চলার কথা, অন্যভাবে যাত্রী নেয়া তো আইনবিরুদ্ধ- এমন মন্তব্যে কথা ঘুরে গেল সাহেদের। দেন অযুহাত। ‘এই তো ফোনে এমবি নাই। কয়েকদিন আগে অ্যাপসও ডিলিট করে দিছিলাম। এখন তাড়াহুড়া আছে। তাই যাইতেছি।’
অ্যাপে না চলে চুক্তিতে চলাচল করলে চালক ও যাত্রী উভয়কেই জরিমানা করার বিধান আছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সিলেটের সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম। তিনি দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, একজন বাইকার ট্রিপ দিতে চাইলে তাকে অ্যাপের পাশাপাশি বিআরটিএ-এর কাছেও রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। অ্যাপ থাকার পরও কেউ যদি চুক্তিতে বাইক চালায় তাহলে তার বিরুদ্ধে বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারবে।
তিনি বলেন, এছাড়া কারো ব্যক্তিগত গাড়ী দিয়ে যাত্রী বহনের কোন সুযোগ নেই। সেটিও অবৈধ। এমন অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। তবে কেউ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেনি। আমরা বিষয়টির খোঁজ নিচ্ছি।
নিরাপত্তাঝুঁকির কথা উল্লেখ করে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মাহফুজুর রহমান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, অ্যাপে না চললে যাত্রী ও চালক কেউই এতে নিরাপদ নন। অ্যাপে চলা যাত্রীদের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যতটা সহজে অপরাধী খুঁজে পাওয়া যায়, এর অন্যথা হলে অপরাধীকে ধরা কঠিন পড়ে পড়ে। চুক্তিতে চলাচলের জন্য ট্রাফিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় কি না, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অ্যাপ রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বাইকে যাত্রী পরিবহন করা সাধারণ আইনেই অবৈধ। যদি কোন বাইকারের অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন থাকে তাহলে কাউকে চুক্তিতে বাধ্য করলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে এ সংক্রান্ত কোন অভিযোগ এখনো আমাদের কাছে আসেনি। এরপরও আমরা বিষয়টির উপর নজর রাখবো।