দায়সারা ফসল রক্ষাবাঁধ : শঙ্কায় সুনামগঞ্জের কৃষক
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ৩:৫৮:১৮ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : দেশের শস্যভাণ্ডার খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বছরে একটিমাত্র ফসলের ওপর নির্ভরশীল। আগাম বন্যায় বারবার ভেসে যায় সেই বোরো ফসল। ২০১৭ সালে হাওরের প্রায় সব ফসল নষ্ট হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। প্রতি বছর সঠিক সময়ে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ করার ওপর জোর দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, কাজের মান ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও তদারকির ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এত কিছুর পরও বাঁধ নির্মাণে অবহেলা ও অনিয়ম যেন নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছর পরিস্থিতি আরও খারাপ। দুই দফা সময় বাড়িয়েও শেষ হয়নি কাজ। অধিকাংশ জায়গায় দায়সারাভাবে কাজ শেষ করায় বাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। ফলে যে কোনো মুহূর্তে পাহাড়ি ঢল নামলেই ভেসে যেতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল। কষ্টের সোনালী ধান নিয়ে শঙ্কায় হাওরপাড়ের কৃষক।
শুধু ধীরগতি নয়- ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়মেরও অভিযোগ উঠেছে। নির্মাণ চলাকালেই নানা জায়গায় শুরু হয় ভাঙন। মাটির পরিবর্তে ফেলা হয়েছে বালু। দূর থেকে মাটি আনার কথা থাকলেও বাঁধের নিচের মাটি দিয়েই উঁচু করা হয়েছে বাঁধ। উন্মুক্ত রয়ে গেছে ১৬৪ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের বেশিরভাগ। কোথাও কোথাও মাটি ফেলার পর ঠিকমতো বসানো হয়নি। ওপরে সামান্য মাটি ফেলে পুরোনো বাঁধকে নতুন দেখানোর চেষ্টাও চলছে সমানতালে। দূর্বাঘাসের জন্য ৪ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও বেশিরভাগ বাঁধে তা লাগানো হয়নি এখনো। কিছু ভাঙ্গনপ্রবণ অংশে এখনো বসানো হয়নি বাঁশ, বস্তা ও চাটাই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলার ১২টি উপজেলায় এবার ৪০ হাওরে ৭৩৫ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ ও সংস্কার হয় ৬৯১ কিলোমিটার বাঁধ। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ২৮টি, বিশ্বম্ভরপুরে ৩১, জামালগঞ্জে ৪৪, তাহিরপুরে ৮২, ধর্মপাশায় ৯৬, মধ্যনগরে ৩২, শান্তিগঞ্জে ৬৬, জগন্নাথপুরে ৩১, দিরাইয়ে ১১০, শাল্লায় ১৩১, দোয়ারাবাজারে ৫১ ও ছাতক উপজেলায় ৩১টি প্রকল্পের আওতায় বাঁধের কাজ করা হয়। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা (ক্লোজার) আছে ১৬৪টি। এ কাজে সব মিলিয়ে এ বছর বরাদ্দ হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় দুই ধাপে সময় বাড়িয়েও শেষ হয়নি কাজ।
জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলায় ৪২টি ছোট-বড় হাওরে বোরো ধান রক্ষার জন্য এবার ৭৩৫টি প্রকল্পের মাধ্যমে বাঁধের কাজ হচ্ছে। গত বছর ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে চলতি বছর ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে তিন দফা সময় বাড়ানো হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন দাবি করছে, বাঁধের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, উল্টোচিত্র। বিভিন্ন বাঁধে মাটির কাজ এখনো চলছে।
কৃষকদের অভিযোগ, কমপেকশন, দূর্বাঘাস লাগানো ও জিওটেক্স লাগানোর কাজও শেষ হয়নি। যেসব বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে, সেখানে কাজ হয়েছে দায়সারা। কাজ চলছে পুরোনো আদলেই। নামমাত্র মাটি ফেলে চলে গেছে প্রজেক্টের লোকজন। ফসল রক্ষায় এ বাঁধের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে কৃষক ও হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতাদের। তাছাড়া আগাম বন্যা হলে অসমাপ্ত বাঁধে ফসল রক্ষা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। সব মিলিয়ে আশঙ্কায় আছেন হাওরের পাড়ের কৃষকগণ।
সুনামগঞ্জের হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান, যা দিয়ে জেলার সারা বছরের খোরাক হয়। তাই ফসলটি এ অঞ্চলের একমাত্র ভরসা। কিন্তু আগাম বন্যায় ফসলহানির ঝুঁকি থাকে। তখন মাঠে মারা যায় চাষির বেঁচে থাকার স্বপ্ন। এ কারণে প্রতি বছরই ফসল রক্ষায় অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করা হয়।
১২ উপজেলার মধ্যে জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও শাল্লা উপজেলার বাঁধের কাজ পিছিয়ে আছে এখনো। কৃষকরা অভিযোগ করছেন, মেয়াদ শেষ হলেও এখন চলছে বাঁধের নির্মাণকাজ। কোথাও কোথাও কমপেকশন, দূর্বাঘাস লাগানো ও জিওটেক্স বসানো হয়নি। বাঁধের কাজের মান নিয়ে কৃষকরা চরম বিক্ষুব্ধ। মাটির বদলে ফেলা হচ্ছে বালু। বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
সাধারণত মার্চের শেষে ও এপ্রিল মাসের শুরুতেই প্রতি বছর আগাম বন্যার আশঙ্কায় থাকেন সুনামগঞ্জের হাওরের কৃষকরা। হাওর এলাকায় এখনো ধানের থোড় আসেনি। এর মধ্যে যদি আগাম বন্যা হয়, তাহলে জেলার ৪২টি হাওরে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে কৃষকের স্বপ্ন। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ‘প্রতি বছরই এ সময়ে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। তবে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে যদি অধিক বৃষ্টি না হয়, তবে বন্যার শঙ্কা তেমন নেই। চলতি মাসের শেষদিকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। মেঘালয়ে অধিক বৃষ্টি হলে আগাম বন্যার শঙ্কা আছে। তবে আমাদের বাঁধগুলো জরুরি মেরামতের জন্য আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে।’
জামালগঞ্জ উপজেলার কৃষক জহির উদ্দিন বলেন, আমাদের এলাকায় হাওরে নামমাত্র মাটি ফেলে বাঁধ করা হয়েছে। এসব বাঁধ অল্প বৃষ্টি হলেই ধসে যাবে।এছাড়া জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলায় বাঁধের কাজ অনেক পিছিয়ে আছে।
শাল্লা উপজেলার নোয়াগাওয়ের কৃষক রনেন্দ্র বলেন, আমাদের এলাকার বাঁধের কাজ এখনো বাকি আছে। এসব কাজ দ্রুত শেষ না করলে আগাম বন্যা হলে ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। সাধারণত মার্চের শেষে ও এপ্রিল মাসের শুরুতেই প্রতি বছর আগাম বন্যার আশঙ্কায় থাকেন সুনামগঞ্জের হাওরের কৃষকরা। হাওর এলাকায় এখনো ধানের থোড় আসেনি। এর মধ্যে যদি আগাম বন্যা হয়, তাহলে জেলার ৪২টি হাওরে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে কৃষকের স্বপ্ন।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এ সময়ে প্রতি বছরই বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। তবে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে যদি অধিক বৃষ্টি না হয়, তবে বন্যার শঙ্কা তেমন নেই। বাঁধের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। চলমান বৃষ্টিতে বাঁধের কোন ক্ষতি হয়নি। দায়সারা বা নিম্নমানের কাজের অভিযোগ সত্য নয়। অনিয়মের স্থান নির্দিষ্ট করে দিলে আমরা সত্যতা যাছাই করে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।
এ ব্যাপারে ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসন দাবি করছে কাজ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। বিগত অন্যান্য যে কোন সময়ের চেয়ে এবারের কাজ হয়েছে নিম্নমানের এবং দায়সারা। বন্যা দুরে থাক কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হলে অধিকাংস বাঁধ ধসে যাবে। আমরা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এবার আমরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। যেসব এলাকায় এখনো কাজ বাকী আছে সেসব এলাকায় পিআইসির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করবো।
২০১৭ সালের ২৮ মার্চ থেকে ভারতের মেঘালয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভারী বর্ষণে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে শতভাগ ফসল তলিয়ে যায়। নিমিষেই শেষ হয়ে যায় ২২ লাখ কৃষকের স্বপ্ন। ২০১৭ সালের পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কোনো দুর্যোগ না থাকায় স্বাভাবিকভাবে ফসল ঘরে তোলা যায়। ২০২২ সালে আগাম বন্যায় আংশিক ফসলহানি হলেও বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি।