সিলেটে ‘বজ্র ঝড়ে’ উদ্বেগ
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪৫:৩৪ অপরাহ্ন
শিলাখণ্ডের নজিরবিহীন আঘাত
ব্যাপক ক্ষতি, অনেকে আহত
বোরো নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা
স্টাফ রিপোর্টার:
সিলেটে হঠাৎ ছোবল হেনেছে কালবৈশাখী। সঙ্গে ছিলো ব্যাপক শিলাবৃষ্টি। আকাশ থেকে পড়া বড় বড় শিলাখণ্ডের আঘাতে অনেক বাসাবাড়ির জানালার কাচ ভেঙে গেছে, টিনের চালে বড় বড় ফুটো হয়েছে। অসংখ্য যানবাহনের ক্ষতি হয়েছে। ফল-ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শিলাখন্ড মাথায় পড়ে অনেকে আহতও হয়েছেন। ঝড়ের সময় থেকে দীর্ঘক্ষণ সিলেট প্রায় বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, রোববার রাতে যা হয়েছে-এটি ছিলো ‘বজ্র ঝড়’। আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে কালবৈশাখী ঝড় বলা হয়। রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে এই ঝড় হয়। এ সময়ে ঝড়বৃষ্টিতে হাওরের বোরো ধান নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষকরা। গত তিন থেকে চার দিনের আবহাওয়া পরিস্থিতি তাঁদের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। নগরের বয়স্ক অনেকে বলছেন, এমন শিলাবৃষ্টি এ যাবৎকালে তারা দেখেননি। একজন প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, তাঁর বয়স ৬৭ বছর। তিনি তাঁর এ বয়সের মধ্যে এত বড় শিলা দেখেননি।
সিলেট বিমানবন্দরের কাছেই ‘এইট ইলেভেন’ নামে একটি রোডসাইড ক্যাফের কর্ণধার আমিনুল ইসলাম পলাশ। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে বলেন, এই শিলাবৃষ্টিতে আমার রেস্টুরেন্ট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টিনের চাল ভেদ করে শিলা ভেতরে ঢুকে গেছে। চাল সবগুলো নষ্ট হয়েছে। রেস্টুরেন্টের বাইরে থাকা প্লাস্টিকের চেয়ার, টেবিল সব ফুটো হয়ে গেছে। শুধু এইট ইলেভেন নয়, সিলেটের অসংখ্য বাসাবাড়ির টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে। আর তার প্রভাব পড়েছে বাজারে। গতকাল নগরের প্রায় সবকটি টিনের দোকানে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। চাহিদা বেশি হওয়ায় টিনের সংকট দেখা দেয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চৈত্রের শেষ ও বৈশাখের শুরুতে দক্ষিণ-পশ্চিমা মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে কালবৈশাখী হয়। এ সময় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ার সময় প্রায়ই মাঝপথে বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী চাপের মধ্যে পড়ে। ফলে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নিচে নামতে নামতে তার কিছু অংশ আবার ওপরে উঠতে শুরু করে এবং আরও ঠান্ডা হতে থাকে। ঘনীভূত পানির ফোঁটাগুলো আরও ভারী হয়ে আবার নিচে নামতে থাকে এবং আবার গরম বাতাসের ঊর্ধ্বমুখী চাপে পড়ে তার কিছু অংশ আবার ওপরে উঠতে থাকে। কয়েকবার ওঠানামা করতে করতে পানির ফোঁটাগুলোর কিছু অংশ ছোট ছোট বরফখণ্ডে পরিণত হয়। এগুলো বেশি ভারী বলে আর ওপরে উঠতে পারে না। বৃষ্টির ধারার সঙ্গে নিচে নেমে আসে। এটাই শিলাবৃষ্টি। শিলাবৃষ্টির প্রধান শর্ত প্রচণ্ড গরম। চৈত্র-বৈশাখ মাসে এ রকম গরম পড়ে। ফলে কালবৈশাখীর সময় শিলাবৃষ্টি হয়। কালবৈশাখীর সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার অন্তত ৪০ জন আহত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যেকের মাথায় সেলাই দিতে হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেটে পাঠানো হয়েছে।
সোমবার দুপুরে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সুদর্শন সেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আহত ৪০ জনের প্রত্যেককে সেলাই নিতে হয়েছে মাথায়। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজনের মাথা ফেটে থেঁতলে গেছে। এ জন্য তাঁদের উন্নত চিকিৎসা ও পরীক্ষা করার জন্য সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গোলাপগঞ্জ ছাড়াও আরো অনেক এলাকায় মানুষজন আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তারা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়েছেন।
বজ্রঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে সুনামগঞ্জে হাজারের উপরে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং হাওরের বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে গাছ পড়ে, বসতঘর ধসে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমপাগলা ইউনিয়-ে নর পাগলাবাজার, রায়পুর কান্দিগাঁও, মির্জাপুর, নবীনগর গ্রামের ঘরবাড়ি বেশি ক্ষতিক্ষন্ত হয়েছে। এদিকে, আর মাসখানেক পরই শ্রমে-ঘামে হাওরে ফলানো ধান গোলায় তুলবেন কৃষকরা। তবে এই বোরো ফসল নিয়ে সব সময়ই চিন্তায় থাকতে হয় তাঁদের। এ সময় হাওর এলাকায় বৃষ্টি, উজানের পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যার শঙ্কা থাকে। যদি এসবের কোনো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়, তাহলে কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যায়।
হাওরপাড়ের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সপ্তাহে সুনামগঞ্জে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। এই হালকা বৃষ্টি ধানের জন্য ভালো ছিল। ধানগাছে ফুল আসার সময় হালকা বৃষ্টি উপকারী। এতে চাল হৃষ্টপুষ্ট হয়। গত তিন দিন সুনামগঞ্জে রোদ কম ছিল। আবহাওয়া ছিল ঠান্ডা। এগুলো ধানের জন্য ক্ষতিকর। এই সময়ে ভারী বৃষ্টি শুধু ধানের ক্ষতি নয়, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধগুলোকে দুর্বল করে দেবে। এতে হাওরের ফসল ঝুঁকিতে পড়বে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৩৭টি হাওর ও বিলে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ মেট্রিক টন। হাওর এলাকার কৃষকেরা নির্বিঘ্নে এই ধান গোলায় তুলতে পারলে তার বাজারমূল্য হবে ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা। আগামী ১৫ এপ্রিল থেকে হাওরে বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ার কথা।
শিলাবৃষ্টির ফলে ফসলের আংশিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা। তিনি বলে শিলাবৃষ্টিতে কৃষকের কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে লাভও হয়েছে। যে জমিগুলোতে পানির সংকট ছিল সেচের ব্যবস্থা ছিল না, সেগুলোতে পানি হয়েছে। এতে ভালো ফসল হওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে। সবজিসহ কিছু ফসল নষ্ট হয়েছে, সেটির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। তবে সবজির শেষ মৌসুম হওয়ায় আহরণ শেষ পর্যায়ে। এতে ক্ষতি কম হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, বছরের এই সময়ে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টিকে কালবৈশাখী বলা হয়ে থাকে। কালবৈশাখীতে শিলাবৃষ্টি হয়।