আল বিদা মাহে রমজান
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ৩:৩০:১৭ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: ইসলাম সবসময় মুসলমানদের একজনের সাথে আরেকজনে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করেছে। একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলবে, একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করবে এটাই হচ্ছে মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। একজন আরেকজনকে খারাপ চোখে দেখবে না, খারাপ কথা বলবে না। ঝগড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে। মুসলমান হবে সমাজের সবচেয়ে ভালো মানুষ। রিয়াদুস সালেহীনে ১৫৬৫ নম্বরে একটি সুন্দর হাদিস এসেছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত। নবী সা. বলেছেন, সেই প্রকৃত মুসলমান যার জিহবা (অর্থাৎ মুখের খারাপ ভাষা, গালাগালি) এবং হাতের অনিষ্ট থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে। মুসলমান মুসলমানকে বিশ্বাস করবে, একজন আরেকজনকে ভালোবাসবে, কেউ কাউকে ছোটো করবে না। এটাই তাদের চরিত্র।
হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত মুসলিম শরীফের হাদিস। রিয়াদুস সালেহীনে এটি এসেছে ১৫৭৪ নম্বরে। নবী সা. বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির খারাপ হবার জন্য এটাই যতেষ্ট যে সে তার মুসলিম ভাইকে অবজ্ঞার চোখে দেখে’। কেউ যদি কাউকে সমাজের চোখে ছোটো করার জন্য পিছু লাগে বা মনে মনে নিজে বড়ো আর তার অপর ভাইকে ছোটো বা নিচু লোক মনে করে তো নবীর সা. কথা অনুযায়ী সে খারাপ মানুষ। আল্লাহর নবীর সা. সময় মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল সুন্দর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ। নবীর সা. পরে সাহাবাদের যুগেও মুসলমানদের সর্ম্পক, চালচলন ছিল নবীর সা. যুগের মতো। আর তাই তাদের সে সময় ছিল সোনার যুগ।
হজরত উমার রা. এর শাসনকাল। একদিন দু’জন লোক এক বালককে টেনে ধরে নিয়ে আসল তাঁর দরবারে। উমর রা. তাদের কাছে জানতে চাইলেন যে, ব্যাপার কী, কেন তোমরা একে এভাবে টেনে এনেছ ? তারা বললো, এই বালক আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে।
উমর রা. বালকটিকে বললেন, তুমি কী সত্যিই তাদের পিতাকে হত্যা করেছ? বালকটি বললো, হ্যাঁ, আমি হত্যা করেছি তবে তা ছিল দুর্ঘটনাবশত, আমার উট তাদের বাগানে ঢুকে পড়েছিল তা দেখে তাদের পিতা একটি পাথর ছুঁড়ে মারলো, যা উটের চোখে লাগে। আমি দেখতে পাই যে উটটি খুবই কষ্ট পাচ্ছিলো। যা দেখে আমি রাগান্বিত হই এবং একটি পাথর নিয়ে তার দিকে মারি, পাথরটি তার মাথায় লাগে এবং সে মারা যায়। উমর রা. দু’ভাইকে বললেন, তোমরা কী এ বালককে ক্ষমা করবে? তারা বললো না, আমরা তার মৃত্যুদ- চাই। উমর রা. বালকটির কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমার কী কোনো শেষ ইচ্ছা আছে?
বালকটি বললো, আমার আব্বা মারা যাওয়ার সময় আমার ছোটো ভাইয়ের জন্য কিছু সম্পদ রেখে যান, যা আমি এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি। আমি তিনদিন সময় চাই, যাতে আমি সেই জিনিসগুলো আমার ভাইকে দিয়ে আসতে পারি। আমার কথা বিশ্বাস করুন। উমর রা. বললেন, আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি যদি তুমি একজন জামিন জোগাড় করতে পারো। বালকটি দরবারের চারদিকে তাকালো। এত মানুষের মধ্যে কেউই তার জামিন হলো না। সবাই নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।
হঠাৎ দরবারের পেছন থেকে একটি হাত উঠলো। প্রখ্যাত সাহাবী হজরত আবু যর গিফারী রা. এর হাত। তিনি বললেন, আমি তার জামিন হবো। সুতরাং বালকটিকে ছেড়ে দেওয়া হলো। প্রথমদিন গেল, দ্বিতীয় দিন গেলো, তৃতীয় দিনে দু’ভাই আবু যর গিফারী রা. এর কাছে গেল।
আবু যর রা. বললেন, আমি মাগরিব পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে আবু যর গিফারী রা. দরবারের দিকে রওয়ানা হলেন। মদিনার লোকজন তাঁর পেছন পেছন যেতে লাগলো। সবাই দেখতে চায় কী ঘটে। আবু যর রা. একটি বালকের ভুলের কারণে আজ জীবন দিচ্ছেন। বালক কী আর ফিরে আসবে? এমন সুযোগ কী কেউ হাতছাড়া করে? হঠাৎ আজানের কিছুক্ষণ আগে বালকটি দৌড়ে আসলো। লোকেরা সবাই অবাক হলো। উমর রা. বললেন, হে বালক তুমি কেন ফিরে এসেছ? আমি তো তোমার পিছনে কোনো লোক পাঠাইনি। কোন জিনিসটা তোমাকে ফিরিয়ে আনলো? বালকটি বললো, আমি চাই না যে, কেউ বলুক একজন মুসলিম কথা দিয়েছিল কিন্তু সে তা রাখে নি তাই আমি ফিরে এসেছি। উমর রা. আবু যর রা. কে বললেন, হে আবু যর তুমি কেন এই বালকের জামিন হলে?
আবু যর রা. বললেন, আমি দেখলাম একজন মুসলমানের সাহায্য প্রয়োজন, আমি চাই না যে, কেউ বলুক একজন মুসলমানের সাহায্য প্রয়োজন ছিল কিন্তু কোনো মুসলমান তাকে সাহায্য করে নি। এ কথা শুনে দুইভাই বললো, আমরাও চাই না যে কেউ বলুক একজন মুসলমান ক্ষমা চেয়েছিল কিন্তু অন্য মুসলমান তাকে ক্ষমা করে নি। তারপর বালকটি মুক্তি পেল।
এটাই হচ্ছে আমাদের ইতিহাস। এটাই হচ্ছে মুসলমানদের গর্বের জায়গা। আজকের দিনে মুসলমানরা তাদের গর্বের জায়গাগুলো হারিয়ে ফেলছে। মুসলমানরা তাদের ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে। আর তাই তাদের চারদিক থেকে কাফির মুশরিকদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে। মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কি হতে পারে। আল্লাহর নবী সা. আমাদের এ নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস। নবী সা. বলেছেন, আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও কঠিন পরীক্ষা, চরম দুর্ভাগ্য, খারাপ তাকদীর এবং কাফিরদের খুশি হওয়া থেকে। ইমাম নববী র. তার রিয়াদুস সালেহীনের ১৪৭১ নম্বর হাদিসে এটি বুখারী এবং মুসলিম শরীফ থেকে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং আজকের দিনে মুসলমানদের কাফির মুশরিকদের কাছে নিজেদের অসহায় মনে করা এটা তাদের অর্জন, তাদের দুর্বলতা। মুসলমানদের সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে তাদের আবার সেই ইতিহাসে পথে ফিরে যেতে হবে যে ইতিহাস তাদের। যে ইতিহাস বিজয়ের। যে ইতিহাস মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রিদওনুল্লাহি তায়ালা আলাইহিম আযমায়িনদের। আর সাহায্য চাইতে হবে আল্লাহর কাছে। তবেই তারা ফিরে পারে আবার তাদের হারানো সেই গৌরব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা বাকারার শেষ আয়াতে মুসলমানদে তা শিখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে তারা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে।
‘হে আমাদের রব, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা ভুল করে গুনাহ করি, তবে আমাদের তুমি আটকিয়ো না। হে আমাদের রব, যেভাবে আমাদের আগেকার জাতিদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছ আমাদের উপর এমন দায়িত্ব অর্পণ করো না, হে রব, যে বোঝা বইবার সামর্থ আমাদের নেই তা তুমি আমাদের দিয়ো না। তুমি আমাদের উপর মেহেরবানী করো। আমাদেরকে ক্ষমা কর এবং আমাদের দয়া করো। তুমিই আমাদের (একমাত্র আশ্রয়দাতা) বন্ধু। কাজেই কাফেরদের মুকাবেলায় তুমি আমাদের সাহায্য করো’।
মুসলমানদের আল্লাহ বিমুখ, কুরআন বিমুখ, সুন্নাহ বিমুখ করবার জন্য নানান ধরণের মায়াজাল কাফির মুশরিক এবং তাদের দোসরা ছড়িয়ে রেখেছে। আর এর সবচেয়ে বড়ো পায়তারা হলো মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের ফাটল ধরানো। কুরআনের শিক্ষা এবং চর্চা থেকে কৌশলে মুসলমাদের দূরে রাখা। কাজেই এনিয়ে মুসলমানদের সতর্ক হতে হবে। বেশি বেশি করে নিজেদের মাঝে কুরআন এবং সুন্নাহর চর্চা অব্যহত রাখতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন!