বান্দরবানে ভয়ঙ্কর কেএনএফ : দিন-দুপুরে ব্যাংক লুট-ম্যানেজার অপহরণ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ৩:৪৩:৩০ অপরাহ্ন
অভিযানে সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনী
জালালাবাদ রিপোর্ট : পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হামলা চালিয়ে টাকা, অস্ত্র লুট করেছে সন্ত্রাসীরা। অপহরণ করেছে একটি ব্যাংকের ম্যানেজারকে। এ হামলা ও লুটের পেছনে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) হাত রয়েছে। ব্যাংকে হামলার তিন সপ্তাহ আগে এক ফেসবুক পেজ থেকে ‘বদলা নেওয়ার’ ঘোষণা দেয় পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী এ সংগঠন।
মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে রুমা উপজেলা প্রশাসন ভবনে হামলা চালায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। পরে সোনালী ব্যাংকের শাখায় হামলা চালানো হয়। সে সময় ব্যাংকে আসা নতুন টাকা লুটের পাশাপাশি ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। প্রথমে বলা হয় ব্যাংকে রাখা ১ কোটি ৫৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকার পুরোটা লুট হয়েছে। তবে সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখা থেকে কোনো অর্থ লুট হয়নি বলে জানিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, একসঙ্গে দুটি চাবি দিয়ে ভল্ট খুলতে হয়। কোনো কারণে অস্ত্রধারীরা হয়তো ভল্ট খুলতে পারেনি।
এসময় ১৪টি অস্ত্রও লুট করে সন্ত্রাসীরা। একই সঙ্গে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের অস্ত্র গুলি লুট করে। এর একদিনের মাথায় গতকাল বুধবার বান্দরবানের থানচি উপজেলায় সোনালী ও কৃষি ব্যাংক লুট করেছে। দুপুরে একটার দিকে থানচি বাজারসহ আশপাশের এলাকাগুলো ঘেরাও করে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে থানচি সোনালী ব্যাংক শাখা থেকে ১৫ লাখ টাকা এবং কৃষি ব্যাংক শাখা দুই লাখ ৪৫ হাজার টাকা লুট করে নিয়ে গেছে।
এ সময় ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে ১৫টি মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নিয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। থানচি থানা থেকে ব্যাংক দুটির দূরত্ব ২০০ গজ। উপজেলা পরিষদের দূরত্ব ৩০০ গজ। থানার কাছে দিনদুপুরে ডাকাতির ঘটনায় স্থানীয় লোকজন হতভম্ব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার রাতে রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংক লুট করে কেএনএফের একটি গ্রুপ। একদিনের ব্যবধানে দিন-দুপুরে থানচি উপজেলা বাজারে অবস্থিত সোনালী ও কৃষি ব্যাংক লুট করে কেএনএফের আরেকটি গ্রুপ।
খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনাস্থলসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তা বিবেচনায় রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িসহ ৬ উপজেলায় সব ব্যাংকে লেনদেন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
বান্দরবানের ব্যাংক লুটের সঙ্গে নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা জড়িত বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, তারা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে (ব্যবস্থাপক) জিম্মি করে নিয়ে গেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ইদানীংকালে কুকি চিন বিভিন্নভাবে অবস্থান জানান দিচ্ছিলো। রুমায় সোনালী ব্যাংকে ঢোকার আগে তারা বিদ্যুতের সাব স্টেশন বন্ধ করে। এরপর সোনালী ব্যাংকে অগ্রসর হয়। আজ আবার তারা থানচিতে কৃষি ও সোনালী ব্যাংকে হামলা করেছে। এখন আমাদের অপারেশন চলছে। কত টাকা লুট হয়েছে এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে কেএনএফ এর দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন সকালে সাংবাদিকদের বলেছেন যে রুমা সোনালী ব্যাংকের অপহৃত কর্মকর্তাকে উদ্ধারে অভিযান চলছে। এর কিছুক্ষণ পরই থানচি বাজারে হামলা ও দুটি ব্যাংকে ডাকাতির খবর আসে। বিষয়টি নিশ্চিত করে থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মামুন জানান, ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনী অভিযানে নেমেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী জানে আলম ও সাগ্যচিং মারমা অভিযোগ করে বলেন, চারদিক থেকে হঠাৎ করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পোশাক পরিহিত ৩০ তেকে ৩৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানচি বাজার ঘেরাও করে। ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে আতঙ্ক ছড়িয়ে বাজারের লোকজনের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। পরে সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে হানা দিয়ে সব টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
রুমায় যেভাবে ডাকাতি হয়েছিলো :
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে মঙ্গলবার রাতে রুমা উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির আগে সেখানকার মসজিদ ঘিরে ফেলেছিলো ডাকাতরা। তাদের গায়ে কেএনএফ এর ইউনিফর্ম দেখেছেন স্থানীয়রা।
হামলাকারীরা দায়িত্বে থাকা দুজন পুলিশ সদস্যকে ব্যারাকে ঢুকিয়ে ফোন ও অস্ত্র কেড়ে নেয়। ব্যারাকের সব পুলিশ সদস্যকে এক ঘণ্টার মতো সেখানে আটকে রাখা হয়।উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের যে ভবনে সোনালী ব্যাংক তার নিচতলায় সরকারি কর্মকর্তারা থাকেন আর দ্বিতীয় তলায় ব্যাংকের উল্টো পাশেই থাকেন পুলিশ সদস্যরা।তবে পরিষদ চত্বরে ঢোকার আগেই ডাকাতরা সেখানকার বিদ্যুতের সাব স্টেশন বন্ধ করে দেয় বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
স্থানীয়রা বলছেন এশার নামাজের সময় মসজিদ ঘেরাওয়ের পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকেও অবস্থান নেয় তারা। ডাকাতদের বিশ জনের মতো মসজিদে প্রবেশ করে ব্যাংক ম্যানেজারকে খুঁজতে শুরু করে। এরপর অস্ত্রের মুখে মুসল্লিদের জিম্মি করে সেখানে থাকা ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে নিয়ে যায় ব্যাংকে।
এরপর ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারের কাছে থাকা চাবি নিয়ে ভল্ট খুলার চেষ্টা করে তারা। তবে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ভল্ট ভাঙতে না পারায় কোনো টাকা লুট করতে পারেনি সন্ত্রাসীরা। ডাকাতি শেষে ব্যাংক ম্যানেজারকে নিয়েই চলে যায় তারা।
রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জসিম উদ্দিন জানান, লুটকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ধরতে যৌথ বাহিনী অভিযানে নেমেছে।
কেএনএফ কারা :
বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। তবে কেএনএফের ঘোষণা ও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অন্তত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। যদিও দলবদ্ধভাবে তাদের বম হিসেবেও প্রচার করছে অনেকে।
কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাথান বম এর নাম গণমাধ্যমে এসেছে। মি. বম এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং বান্দরবানের রুমা উপজেলায় তার বাড়ি বলে জানা যাচ্ছে।২০২২ সালের দিকে এ সংগঠনটি আলোচনায় আসে। তখন তাদের ফেসবুকে ও ইউটিউব পোস্টে সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শুরু থেকেই সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছিলো।
এরপর স্থানীয় একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি কয়েকটি ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে গত নভেম্বরে কেএনএফ এর সাথে সরাসরি আলোচনায় বসতে সক্ষম হয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বিতীয় সরাসরি বৈঠকটি হয়েছিলো।