ঈদ-নববর্ষের ছুটিতে সিলেটে রেকর্ডসংখ্যক পর্যটক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৬:০২ অপরাহ্ন
৫ থেকে ১০ লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম হয়েছে : জেলা প্রশাসক
এমজেএইচ জামিল : উঁচু টিলা, ঢেউ খেলানো চা বাগান, নীল জলের লালাখাল, পাথুরে বিছানায় ভেসে চলা ঝর্ণার ধারা কিংবা জলের মধ্যে ভেসে ওঠা অরণ্য-রাতারগুল। সঙ্গে হযরত শাহজালাল (র.) ও শাহপরান (র.) মাজারসহ আরো অনেক পর্যটন স্পট। এ কারণেই বিনোদনপ্রেমিদের কাছে সিলেট সবসময়ই পছন্দের তালিকায়। এবারও ঈদ ও নববর্ষের লম্বা ছুটিতে পর্যটকদের ঢল নেমেছে প্রাকৃতি সৌন্দর্য্যরে লীলাভুমি সিলেটে। ব্যাপক উপস্থিতির কারণে নগরীর হোটেল-মোটেলগুলোতে খালি ছিলনা কোন রুম।
এবার সিলেটে ৫ থেকে ১০ লক্ষাধিক পর্যটকের সমাগম ঘটেছিল বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান। একই সাথে যে কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি ঠেকাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল বলেও জানান তিনি। বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ছোট খাটো অপ্রীতিকর ঘটনায় সাথে সাথে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
করোনা পরবর্তী দীর্ঘস্থায়ী কয়েকদফা বন্যাসহ টানা কয়েক বছরের মন্দাবস্থার পর ঈদ ও নববর্ষের ছুটি উপলক্ষে চাঙা হয়ে উঠে সিলেটের পর্যটন খাত। এই ছুটিতে ব্যাপকসংখ্যক পর্যটক পদচারণায় মুখরিত হয় সিলেট। দীর্ঘদিন পর পর্যটকদের এমন জোয়ারে খুশি সিলেটের পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা।
তবে পর্যটন স্পটে ইভটিজিংসহ কয়েকটি অনাকাঙ্খিত ঘটনায় বদনাম কুড়িয়েছে সিলেট। যদিও প্রশাসনের তড়িৎ পদক্ষেপের কারণে সন্তুষ্ট হয়রানীর শিকার পর্যটকগণ।
পবিত্র ঈদুল ফিতর ও বাংলা নববর্ষের লম্বা ছুটিতে প্রকৃতি কন্যা সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রে গুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। বরাবরের মতো এবারও পর্যটক দর্শনার্থীদের ঢল নামে সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। তবে নিকট অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় এবারের ঈদ ও নববর্ষের ছুটিতে। ঈদের দিন বৃহস্পতিবার থেকেই সিলেট নগরী, সিলেট জেলা, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের সকল পর্যটন স্পটে ভিড় করেন ভ্রমণপপিপাসীরা। তবে এই সময়ে সিলেটসহ স্থানীয় পর্যটকের সংখ্যাই বেশি ছিলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের দিন থেকে শুরু করে বাংলা নববর্ষের দিন রোববারও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দর্শনার্থীদের উপস্থিতির কোন কমতি ছিলনা। নগরীর বাহিরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় রয়েছে সবচেয়ে বেশি পর্যটনকেন্দ্র। আর ঈদ ও নববর্ষের ছুটিতে এতে যেন প্রাণ ফিরে পায় উপজেলার সবকটি পর্যটনকেন্দ্র। এই সময়ে নগরীর চা বাগান সহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মেঘ-পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন দর্শনার্থীরা।
গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং, বিছনাকান্দি, সোয়াম ফরেস্ট রাতারগুল ছাড়াও পানতুমাই ঝরনা, জাফলং চা বাগান ও মায়াবী ঝরনা পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি মুখরিত হয়ে উঠে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর পর্যটন স্পট।
পর্যটকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, পাহাড়, পাথর আর স্বচ্ছ জলের সমাহার দেখে তাঁরা বিমোহিত হয়েছেন। পরিবার-পরিজন বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে তারা এসেছেন প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
এদিকে সিলেটের জাফলংয়ে কয়েকজন নারী ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়ায় এক তরুণকে দুই বছরের কারাদন্ড ও দুই কিশোরকে মুচলেকা নিয়ে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার (১২ এপ্রিল) বিকালে জাফলংয়ে ঘটনায় দ-প্রাপ্ত তরুণ হচ্ছে- সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল গ্রামের অহিদুর রহমানের ছেলে জাহিদুর রহমান (২১)। বাকি দুজন কিশোর হওয়ায় তাদের পরিবারকে খবর দিয়ে নিয়ে এসে মুচলেকা দিয়ে পরিবারের জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (জাফলং এরিয়া) মো রতন শেখ (পিপিএম) জানান- সুনামগঞ্জের ছাতক থেকে একটি পরিবার জাফলংয়ে বেড়াতে এসে দুই কিশোর ও এক তরুণের ইভটিজিংয়ের শিকার হন ওই পরিবারের নারীরা। তৎক্ষণাৎ ভিকটিমরা বিষয়টি ট্যুরিস্ট পুলিশকে জানালে আমরা ইভটিজারদের আটকে উপজেলা প্রশাসনকে খবর দেই। পরে উপজেলা আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্যাট গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তৌহিদুল ইসলাম এসে ওই তরুণকে দুই বছরের কারাদ- প্রদান করেন।
জাফলং, সাদাপাথর ছাড়াও বিছনাকান্দি, রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট, পানতুমাই ঝরনা, লালাখাল ও সিলেটের বিভিন্ন চা বাগানে বৃহস্পতিবার ঈদের দিন থেকেই পর্যটকদের ঢল নামে। সিলেটের বেশির ভাগ হোটেল-রিসোর্ট ছিল অতিথিতে পরিপূর্ণ।
সিলেট শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে সাদাপাথর। সাদা পাথুরে নদীর শীতল জল আর পাশেই দিগন্ত বিস্তৃত মেঘালয় পাহাড়। প্রকৃতির এ অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। ঈদ মৌসুমে পর্যটক সমাগম আরও বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
ঈদের ছুটিতে সাদাপাথরে গিয়ে দেখা যায়, পর্যটকদের কারণে নদীতে পা ফেলার অবস্থা নেই। ভিড়ের কারণে অনেকে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন; নামতে পারছিলেন না পানিতে। সাদাপাথর ঘুরতে আসা ঢাকার রুমা বেগম বলেন, ‘এই পরিবেশ অপরূপ। যে কেউ আসলে মন ভালো হয়ে যাবে।’
এদিকে ঈদের ছুটিতে বিভিন্ন পর্যটন স্পট সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটক দর্শনার্থীমুখর হয় উঠে জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুল। তবে বিছনাকান্দি রাতুলগুলের তুলনায় পর্যটক উপস্থিতি বেশি ছিলো জাফলংয়ে। সবুজের আস্তরণে মেঘালয়ের বিস্তৃত চোখ জোড়ানো সবুজ টিলা, পাহাড়, বয়ে চলা স্বচ্ছ জলরাশি, নুড়িপাথরের কলতানের সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য ভ্রমণে জাফলং ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। গ্রীস্মের তাপদাহেও প্রকৃতি প্রেমিরা ছুটে এসেছেন প্রকৃতির কাছাকাছি। বরাবরের মতো এবারও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তাঁরা বিমুগ্ধ। পাহাড়,টিলার সাথে সাদা মেঘের লুকোচুরী। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই প্রকৃতি যেন সেজেছে তার আপন মহিমায়। আগন্তকদের মধ্যে পরিবার-পরিজন আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভ্রমণপিয়সীরা স্থানগুলো দর্শন করছেন। প্রতিটি স্পষ্টই লোকে লোকারন্য। প্রকৃতির এমন কাছাকাছি আসতে পেরে তারা খুশি। বৃহস্পতি, শুক্র, শনি ও রোববার দিনব্যাপী গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং, বিছনাকান্দি, সোয়াম ফরেস্ট রাতারগুল ছাড়াও পানতুমাই ঝর্ণা,দেশের একমাত্র সমতল জাফলং চা বাগান ও মায়াবী ঝর্ণাতেও পর্যটকদের পদচারণা ছিলো চোখে পড়ার মতো।
তবে সব চাইতে বেশি পর্যটকের ভিড় ছিল জাফলং জিরো পয়েন্ট। যাদের বেশিরভাগ দর্শনার্থীই ছিলেন উঠতি তরুণ-তরুণী। নদী, স্বচ্ছ জল, আর ভারতের মেঘালয়ের ওমঘট নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ, টিলা পাহাড়ের পাশাপাশি এখানকার খাসিয়া পল্লী, মায়াবী ঝরণাও মন কাঁড়ে ভ্রমণপ্রেয়সীদের। পর্যটক সমাগম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানকার হোটেল মোটেল রিসোর্টে কোন রুম খালি ছিলনা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অগণিত পর্যটকরা আগেই ফোন ও অনলাইনে বুকিং দিয়ে রাখেন সবকটি হোটেল মোটেল রিসোর্টের রুম সমুহ। জাফলং জিরো পয়েন্টের আশপাশের সবকটি খাবার হোটেল রেস্টুরেন্টের জমজমাট বিকিকিনি চোখে পড়ে। সেখানকার হোটেল রেস্টুরেন্টের মালিকরা জানান, পর্যটক, দর্শনার্থীদের সমাগম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের হোটেল রেস্টুরেন্টের বিকিকিনি অনেকটা বেড়েছিল। পর্যটকদের কথা বিবেচনা করে সূলভ মূল্যে সব ধরনের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। পর্যটকরাও তাদের রুচি অনুসারে পছন্দ সহকারে খাবার কিনে খেয়েছেন বলে জানান তারা।
এ ব্যাপারে সিলেট হোটেল এন্ড গেস্ট হাউস ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া দৈনিক জালালাবাদকে জানান, গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার সিলেটে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। তবে স্ট্যান্ডার্ড মানের হোটেল গুলোতে শতভাগ রুম বুকিং হয়নি। মধ্যম মানের হোটেল গুলোতে রুম খালি ছিলনা। সবমিলিয়ে এবারের ঈদ-নববর্ষের ছুটিতে সিলেটের পর্যটনখাত প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে।
সিলেট হোটেল এন্ড গেস্ট হাউস ওনার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নওশাদ আল মুক্তাদির দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, করোনা ও ভয়াবহ বন্যা পরবর্তী সময়ে সিলেটের পর্যটন খাত মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এবারের ঈদ-নববর্ষের ছুটিতে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটকের আগমণে সিলেটের পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা কিছুটা হলেও লাভবান হয়েছেন। তবে সিলেটের ভালো মানের হোটেলগুলোতে ৭০-৮০ ভাগ রুম বুকিং হয়েছিল। মধ্যম ও সাধারণ মানের হোটেলগুলোতে লোক সমাগম তুলনামুলক বেশী হয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এবারের ঈদ-নববর্ষের ছুটিতে সিলেটে ৫ থেকে ১০ লক্ষাধিক পর্যটকের আগমন ঘটেছে। পর্যটক বরণে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, বিজিবি ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন সার্বক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। যে কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি ঠেকাতে আমাদের পক্ষ থেকে পর্যটন এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। দুয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনার সাথে সাথেই ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পর্যটন স্পটে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে কয়েকজন নৌকার মাঝির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এবার সিলেটে আসা পর্যটকগণ নির্বিঘ্নে অবকাশ যাপন করতে পেরেছেন।