জলাবদ্ধতায় হাওরে ডুবছে কৃষকের স্বপ্ন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩:০০:২৭ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল, সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে :
সোনালী ফসল বোরো ধান তোলার উৎসবে মেতে উঠার অপেক্ষায় হাওরপাড়ের কৃষক। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ধানকাটা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে হাওরজুড়ে পড়তে ধান কাটার ধুম। উৎসবের মাঝেও কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে হাজার হাজার কৃষকের। বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে অনেক হাওরে ডুবছে কৃষকের স্বপ্ন। সামান্য বৃষ্টিপাত হলে পরিস্থিতি হবে আরো জটিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিপাত ও পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অসময়ে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে অনেক হাওরের বোরো ধান। বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে ডুবে আছে সুনামগঞ্জ সদর, শান্তিগঞ্জ, জগন্নাথপুর, ছাতক, জামালগঞ্জ, তাহিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার কৃষকের ধান। ইতোমধ্যে পানিতে তলিয়ে আছে হাওরের কয়েকশত একর কাঁচা ধান। খবর পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে জলাবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন ও জেলা কৃষি বিভাগ।
কৃষকরা জানিয়েছেন, উজানে বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢলে পানি প্রবেশ করে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় সদর উপজেলার রঙ্গাচর ইউনিয়নে কাংলার হাওরের শতাধিক হেক্টর জমির ফসল বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তত ২০০ হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, নন হাওরে ৭০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হলেও বৃষ্টিপাত না হলে তা ভাটিতে নেমে যেতে পারে। এতে ফসলের ক্ষতির পরিমাণ কম হবে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম।
এদিকে টানা বৃষ্টিতে জেলার সদর উপজেলার ঝাউয়ার হাওর, শিয়ালমারা হাওর, দেখার হাওরের কিছু নিচু এলাকা এবং শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাখিমারা, জামখলার হাওরসহ জেলার বিভিন্ন হাওরে অন্তত হাজার হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়াগেছে। এতে ফসলের সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কিত সংশ্লিষ্ট হাওরের কৃষকরা।
এছাড়াও পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বেড়ে তাহিরপুর উপজেলার কৃষকদের উদ্যোগে নির্মাণ করা নজরখালি বাঁধ ধসে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে টাঙ্গুয়ার হাওরে সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর বোরো জমির ফসল। বাঁধ রক্ষায় স্থানীয় হাওর পাড়ের কৃষকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নদীতে পানি বাড়লে যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন কৃষকরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নজরখালি বাঁধ টাঙ্গুয়ার পাড়ে হওয়ায় চলমান প্রকল্পের বাইরে থাকায় সেখানে সরকারিভাবে কোনো বাঁধ তৈরি হয়নি। এই বাঁধটি স্থানীয় কৃষকরাই রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলার বিভিন্ন হাওরের ফসল রক্ষায় ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দে ৭৩৪ প্রকল্পে ৫৯১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাঁধের কাজ শতভাগ শেষ হওয়ায় প্রকৃতির আপদকালীন ঝুঁকি মোকাবেলায় নির্মিত বাঁধ সক্ষম বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার।
তিনি বলেন, বাঁধ নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। অন্যান্য যেকোনো বারে চেয়ে এবারের বাঁধ মজবুত হয়েছে। নদীতে পানি বাড়লে এর চাপ সহ্য করায় সক্ষম সকল বাঁধ। বড়ধরনের কোনো বিপর্যয় না হলে বোরো ফসল ঝুঁকিমুক্ত বলে জানান তিনি।
তবে বাঁধ নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এমন কথায় বিশ্বাসী নয় হাওর ও কৃষকের সংগঠন হাওর বাঁচাও আন্দোলন। সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, নির্ধারিত সময়ে মধ্যে বাঁধের কাজ করতে পারেননি কর্তৃপক্ষ। শেষবেলাতে অনেক তাড়াহুড়ো করে বাঁধের কাজ করা হয়েছে। এতে বাঁধের কম্পেকশন ঠিক হয়নি। অনেক বাঁধ নড়েবড়ে অবস্থায় রয়েছে। এসব দুর্বল বাঁধ পানির চাপ সহ্য করতে পারবে না। তাই আপদকালীন সময়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সতর্ক থাকার আহ্বান সংগঠনের এই নেতার।
অপরদিকে আহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে সিলেট সুনামগঞ্জ এলাকায় বজ্রসহ কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে মেঘালয় চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা কম থাকার বিষয়টি হাওর অঞ্চলের জন্য স্বস্তির বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসেন।
এবার সুনামগঞ্জ ১২ উপজেলার ছোটবড় ১৪০টি হাওরে দুই লাখ ২৩ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। যা অতীতের চেয়ে বেশি বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। আবাদকৃত জমি থেকে ১৩ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিকটন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম।
তিনি বলেন, এবার প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় সুনামগঞ্জে ফসল ভালো হয়েছে। ইতোমধ্যে আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পরেই পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে।
জানা গেছে, আর কদিন পর পাকা ধান ঘরে তোলার কথা ছিল কৃষকদের কিন্তু সেখানে পানিতে ডুবে যাওয়া কাঁচা ধান কাটতে কাজ করছেন কৃষকেরা। তাও সেটা গরুর খাবারের জন্য। সুনামগঞ্জ শহর, বরদই বিলের পানি ও বৃষ্টির পানিতে হাওরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ থাকায় কয়েক শত একর কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে দরিদ্র কৃষকরা ও গবাদিপশুর ঘাসের জন্য কিছু কৃষক পানি থেকে কাঁচা ধান কেটে তোলছেন। কাঁচা ধান তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা বিপাকে।
জানা যায়, প্রতি বছরের ন্যায় এবার এই হাওরে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে এবং ধানের ফলনও ভাল হয়েছিল কিন্তু বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে দেখার হাওরের সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের দরিয়াবাজ, কলাউড়া, ইছাগড়ি, হুরমত নগর, রউয়ারপাড়, গুয়ারছড়া, হরিপুরসহ ৭টি গ্রামের কয়েক শত কৃষকের ৫০০ হেক্টরেরও বেশি কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের কৃষক ইউসুফ আলী। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে ২০ একর জমিতে করেছিলেন বোরো ধান। পরিশ্রমে ফলানো সেই ধান আর কয়েকদিন পর ঘরে তোলার কথা থাকলেও গত ৩ দিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে। তাই কোমরপানিতে নেমে আধাপাকা ধান কেটে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
ইউসুফ আলী বলেন, আমার স্বপ্নের ফসল বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। ছেলে মেয়ে এবং ঋণ কীভাবে পরিশোধ করবো সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
হাওরপাড়ের কৃষকরা বলেন, অনেক কষ্ট করে ফসলের আবাদ করেছিলাম, কিন্তু ফসল পুরোপুরি পাকার আগেই বৃষ্টির পানিতে হাওরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ধান তলিয়ে গেছে। এখন এই ধানগুলো কোনো রকমে পানির নিচ থেকে তুলছি গবাদিপশুর খাবার হিসেবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপ পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম দৈনিক জালালাবাদকে জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে। দেখার হাওরে ৫০ একর জমি জলাবদ্ধতায় ডুবে গিয়েছিল। এর প্রেক্ষিতে সেচ পাম্প বসিয়ে পানি কমানো হয়েছে। কিছু হাওরে স্লুইস গেটে খুলে পানি নিষ্কাশন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, হাওরজুড়ে ধান কাটা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৪ হাজার হেক্টর বোরো ধান কাটা হয়েছে। জেলায় ৯৭৫টি হারভেস্টর কম্বাইন্ড প্রস্তুত রয়েছে। ১৫ দিনের মধ্যেই হাওরের সব ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।