বিশৃঙ্খল সড়কে নৈরাজ্য চরমে
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৫:৪৪ অপরাহ্ন
দুর্ঘটনার সাথে বাড়ছে মৃত্যুও
জালালাবাদ রিপোর্ট : কাজে আসছে না সড়কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন। বিশৃঙ্খল সড়কে নৈরাজ্য চরম আকার ধারণ করেছে। দুর্ঘটনার সাথে বাড়ছে মৃত্যুও। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বিপুল ব্যয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকান্ড।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে বিপুল ব্যয় হলেও যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স নিশ্চিত করা, বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানো ও শ্রমিকদের মাদক গ্রহণ বন্ধ করা, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করা, সড়কের ত্রুটি দূর করা, অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করা- এসব নিশ্চিত করা যায়নি আদৌ। ফলে দুর্ঘটনা কমেনি। সারাদেশের সড়কে বর্তমানে ৬ লাখেরও বেশি যানবাহন চলছে অবৈধভাবে, যাদের হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সড়কে শৃঙ্খলা না থাকার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে পরপর দুদিন দুটি বড় দুর্ঘটনার পর। বুধবার দুপুরে ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোলপ্লাজায় একটি দ্রুতগতির ট্রাক তিনটি ইজিবাইক, একটি প্রাইভেটকার ও একটি ছোট ট্রাককে ধাক্কা ও চাপা দিলে ১৪ জন মারা যান। অথচ ইজিবাইক মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ। এর একদিন আগেই ফরিদপুরে বাস ও যাত্রীবাহী ট্রাকের সংঘর্ষে ১৫ জন মারা যান। দুর্ঘটনায় পড়া বাসটির রুট পারমিট (নির্দিষ্ট পথে চলাচলের অনুমোদন), হালনাগাদ ফিটনেস সনদ ও ট্যাক্স টোকেন (কর পরিশোধের সনদ) কিছুই ছিল না। মারা যাওয়া ব্যক্তিরা ছিলেন ছোট ট্রাকের যাত্রী। যদিও আইনে ট্রাকে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ। বৃহস্পতিবারও সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কে সুরমা ব্রিজের কাছে বাসের সঙ্গে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে কণ্ঠশিল্পী পাগল হাসানসহ দুজন নিহতের ঘটনা ঘটে। অথচ হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে সিএনজিচালিত এসব গাড়ি মহাসড়কে উঠতেই পারবে না। এদিকে বুধবার দিবাগত রাতে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার মডেলবাজার নামক স্থানে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বাস চাপায় ২ জন নিহত হয়েছেন।
জানা গেছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে রাজপথে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। তীব্র আন্দোলনের মুখে সে সময় তড়িঘড়ি করে সড়ক পরিবহন আইনও প্রণয়ন করে সরকার। যদিও ওই আইনের কাটাছেঁড়া চলছে এখনো। ওই আইনে শাস্তির ধারা শিথিল করে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সংশোধনেরও। এর আগে ২০১৫ সালের আগস্টে মহাসড়কে নসিমন-করিমন, ভটভটি, ইজিবাইকসহ সব ধরনের তিনচাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ করে হাইকোর্ট।
সেই সময় একইসাথে এসব যান চলাচল বন্ধে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ৯ বছর। কিন্তু এখনও তা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি, সড়কেও ফেরেনি শৃঙ্খলা। আবার ২০১৯ সালেও চালকদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। তাও হচ্ছে না যথাযথভাবে। টেস্ট না করিয়েও দালাল চক্রের মাধ্যমে সার্টিফিকেট পাচ্ছেন চালকরা। এসব অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা রোধের চেয়েও অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে অনেকটা বেশিই। দুর্ঘটনা রোধে যা কোনো কাজেই আসছে না- বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য সড়কের শৃঙ্খলা নিশ্চিতে জোর দেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যুগ যুগ ধরে এ নিয়ে বলা হলেও তাতে যেন কর্ণপাতই করছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনীহাও অনেকটাই দৃশ্যমান। যে কারণে সড়ক থেকে সরছে না নিষিদ্ধ যান, কমছে না দুর্ঘটনা বরং বড় বড় দুর্ঘটনায় ক্রমেই বাড়ছে মৃত্যু।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে যানবাহন আছে ৬০ লাখের মতো। এর মধ্যে ৪৪ লাখের মতো মোটরসাইকেল, যার কোনো ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। বাকি যে ১৬ লাখ যানবাহন রয়েছে, তার মধ্যে ৬ লাখ ১৮ হাজারের মতো যানের ফিটনেস সনদ হালনাগাদ নেই। অর্থাৎ ফিটনেস সনদ নেয়া বাধ্যতামূলক যানবাহনের মধ্যে প্রায় ৩৯ শতাংশ এই সনদ ছাড়াই অবৈধভাবে চলাচল করছে। এর প্রভাব পড়ছে সড়ক-মহাসড়কে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুও ক্রমেই বাড়ছে। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও রয়েছে ঠেলাঠেলি। বেসরকারি হিসাবে যেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি সেখানে সরকারি হিসাবে দেখা যায় কম। হিসাবের গরমিল থাকলেও দিনশেষে দুই হিসাবেই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
বিআরটিএর হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে চার হাজার ১৩৮ জন। ২০২৩-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ২৪ জনে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয় ৫ হাজার ২১১ জনের। গত বছর প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৫২৪ জনে। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এনআরএসসি ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে নছিমন-করিমন, থ্রি-হুইলার, অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও সব অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় বিআরটিএ, জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ। সেই সিদ্ধান্তটিও বাস্তবায়িত হয়নি আদৌ। তবে পরপর বড় দুটি দুর্ঘটনার পর নড়েচড়ে বসছে বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও সড়কে শৃঙ্খলা জোরদারে প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার।
তিনি বলেন, অবৈধ নসিমন-করিমন, থ্রি-হুইলার, ফিটনেসবিহীন মোটরযান ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল সড়ক মহাসড়কে চলাচল, মোটরযানের অতিরিক্ত গতি এবং মালবাহী গাড়িতে যাত্রীবহন রোধ তথা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের সাথে সমন্বয় করে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় জোর দেয়া হয়েছে।
পুলিশ, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ও যাত্রীকল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যায় ওপরের দিকে থাকছে মোটরসাইকেল এবং নছিমন-করিমন, অটোরিকশার মতো তিন চাকার যানবাহন। সারা দেশে সড়ক ও মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নছিমন-করিমন চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ২০১১ সালে। তারও বাস্তবায়ন নেই মহাসড়কে।
জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দিন খান বলেন, মহাসড়কে নিয়ম ভেঙে যে সব যান চলাচল করে বা অনিরাপদ ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী তুলে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এরপর ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আগেও বিআরটিএ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তায় যৌথ অভিযান করেছি। মহাসড়কে অনিয়মের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিআরটিএর চিঠির বিষয়ে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন বিআরটিএর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হবে।