দেশজুড়ে তাপপ্রবাহ, নানা ঝুঁকি
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ এপ্রিল ২০২৪, ৩:৩০:৫৫ অপরাহ্ন
*স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ৭ দিন ছুটি *যশোরে তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬*মে মাসও উত্তপ্ত হওয়ার আভাস
জালালাবাদ রিপোর্ট : তাপপ্রবাহে পুড়ছে প্রায় সারা দেশ। শনিবার ঢাকায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে। রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে, ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাবনায় হিটস্ট্রোকে একজনের মৃত্যু হয়েছে। সিলেটেও অস্বস্তির তাপমাত্রায় জনজীবনে প্রভাব পড়েছে। আগামী কয়েক দিন তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনাও কম বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এই ছুটির ফলে ২৮ এপ্রিল খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শনিবার দুই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোর পক্ষ থেকে পৃথকভাবে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। ছুটি শেষে আজ রোববার তা খোলার কথা ছিল।
চলতি এপ্রিল মাসের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ শুরু হয়। ৭ ও ৮ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হয়। এতে তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়। এরপর ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। ১৫ এপ্রিল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র তাপপ্রবাহ বইতে শুরু করে। এই তীব্র তাপপ্রবাহের এলাকা ধীরে ধীরে বেড়ে যায়। আর গতকাল থেকে দেশের একাধিক এলাকায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বইতে শুরু করেছে।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হলে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে থাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
এই তাপপ্রবাহের কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তর তিন দিনের জন্য (১৯ থেকে ২১ এপ্রিল) তাপপ্রবাহের সতর্কবার্তা বা হিট অ্যালার্ট জারি করে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবুল কালাম মল্লিক গণমাধ্যমকে জানান, চলমান তাপপ্রবাহ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। মে মাসও উত্তপ্ত মাস হিসেবে বিবেচিত হবে। মে মাসেও তীব্র গরম থাকবে। সর্বোচ্চ ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠতে পারে তাপমাত্রা।
আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেসা বলেন, ২৪-২৫ তারিখের দিকে তাপপ্রবাহের তীব্রতা কমে আসলেও এ মাসজুড়েই বিরাজ করবে তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা বেশি থাকার জন্য অপরিকল্পিত উঁচু ভবন, জমি ভরাট, ভারী যানবাহন নির্গমন, এয়ার কন্ডিশনার এবং জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার এবং বৃক্ষ নিধনকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া ‘এল নিনো’ ও একটা কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এল নিনোর কারণে মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তৈরি হতে পারে খাদ্য, পানি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ঝুঁকি। মূলত এটি হচ্ছে, প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষরেখার দক্ষিণের আবহাওয়ার এলোমেলো আচরণ। সাধারণত দুই থেকে সাত বছর পরপর এল নিনো পরিস্থিতি তৈরি হয়। যা ১৮ মাসের বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে।
এল নিনো হলো প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এই স্রোতের ফলে উষ্ণ হয়ে প্রকৃতি। এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধের পুবালী বায়ুর প্রবাহ বদলে যায়।
ঝুঁকিতে মানুষ :
দেশের পাঁচটি প্রধান শহরের ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রচ- গরমের বিপদে রয়েছেন। গ্রীষ্মকাল তো বটেই, ভরাবর্ষায়ও তাপপ্রবাহের কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় পড়ছেন তাঁরা। এর মধ্যে ৯ বছরের কম ও ৬৫ বছরের চেয়ে বেশি বয়সী মানুষেরা গরমের কারণে সবচেয়ে বেশি শারীরিক সমস্যায় পড়ছেন।অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ গবেষণায় দাবদাহ বা প্রচ- গরম নিয়ে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, এ তাপপ্রবাহের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার সক্ষমতার বিষয়টি যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে আর্থসামাজিক। যেমন তাপপ্রবাহের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামের অধিবাসীদের। ওই শহরের মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশের সে সক্ষমতা রয়েছে। ঢাকার তা ৭৯ দশমিক ৩ শতাংশ, খুলনার ৭৯ শতাংশ, রাজশাহীর ৮৭ ও সিলেটের ৪৮ শতাংশ।
এ অবস্থায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অ্যাসেম্বলি (প্রাত্যহিক সমাবেশ) বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, চলমান তাপপ্রবাহে শিশুশিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিবেচনায় ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশুকল্যাণ ট্রাস্টের বিদ্যালয় ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর লার্নিং সেন্টারগুলো বন্ধ থাকবে।
এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে মাউশির অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে পরের দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি। এর ফলে কার্যত এই ছুটি হবে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত।
মাউশির মহাপরিচালকের রুটিন দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরী এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেন, আবহাওয়া পরিস্থিতির অবনতি বা উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে।এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলো মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একজন উপপরিচালক জানান, মাউশির অধীন স্কুল ও কলেজগুলোর মতো তাদের অধীন মাদ্রাসাগুলোতেও ছুটি থাকবে। অর্থাৎ মাদ্রাসাগুলোও খুলবে ২৮ এপ্রিল।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক বলেন, তারাও মাউশির অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন।
তীব্র তাপদাহের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ক্লাস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শনিবার বিকেলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।দেশজুড়ে চলমান প্রচ- তাপপ্রবাহের কারণে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে মামলার শুনানিতে আইনজীবীদের গাউন পরার আবশ্যকতা শিথিল করা হয়েছে।
এদিকে ভ্যাপসা গরমে জনজীবনে অস্বস্তি নেমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন কৃষক-শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষ। ধান, আম, লিচু ও সবজির ফলন এবং হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল নিয়ে কৃষকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
ভ্যাপসা গরমের কারণে গায়ে ঘাম বসে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া অ্যাজমা, হাঁপানিসহ শ্বাসকষ্টের রোগীদের ভোগান্তি বেড়েছে।
এদিকে আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শীলা বৃষ্টি হতে পারে।