শ্রমিক ও হারভেস্টার সংকট
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ৩:০০:২১ অপরাহ্ন
বাম্পার ফলনেও উদ্বিগ্ন কৃষক
এমজেএইচ জামিল : সুনামগঞ্জের হাওরপাড় জুড়ে বোরো ধান তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। ইতোমধ্যে জেলার সকল উপজেলায় ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। এবারের ভালো ফসলে কৃষকের চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেছে। তবুও শ্রমিক ও হারভেস্টার সংকটে যথাসময়ে ধান তোলা নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক।
কৃষি বিভাগের মতে জেলায় পর্যাপ্ত হারভেস্টার কম্বাইন রয়েছে এবং ইতোমধ্যে ৫০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে বাস্তবে হারভেস্টর সংকট এবং জেলায় ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ ধান কাটা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রকৃতি এবার দু’হাত ভরে দান করেছে হাওরের কৃষকদের। বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনারাঙা পাকা ধান। তা দেখে কৃষকের মুখে ছড়িয়ে পড়ছে হাসির ঝিলিক। বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে ধান কাটার উৎসবে মেতে উঠেছে হাওরের কৃষকরা। ১৫ থেকে ২০ দিন অনুকূল আবহাওয়ার প্রত্যাশা করছেন হাওরাঞ্চলের কৃষকরা।
কৃষকরা বলছেন, খুবই ভালো ফলন হয়েছে। তবে ধান কাটা, মাড়াই ও ঘরে তোলার বিশাল কর্মযজ্ঞে দেখা দিয়েছে শ্রমিক ও হারভেস্টার সংকট। বাড়তি মজুরি দিয়েও শ্রমিক মিলছে না। রয়েছে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনের সংকটও। ধান কাটার ভরা মৌসুমে কম্বাইন হারভেস্টার কেলেংকারী নিয়ে জেলাজুড়ে আলোচনা রয়েছে। কৃষকরা ধান কাটার এই যন্ত্র না পেয়ে হন্যে হয়ে ঘুরছেন।
সুনামগঞ্জের হাওর বেষ্টিত ভাটি জনপদ ও হাওরের জেলায় এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলার ১২ উপজেলার ১৩৭টি হাওর জুড়ে পুবালি বাতাসে এখন দোল খাচ্ছে আধা-পাকা সোনালী ধান আর ধান। এই ধান কাটতে শুরু করেছেন এ অঞ্চলের কয়েক লক্ষাধিক কৃষক। অন্যদিকে কৃষক-কৃষাণীরা এই ধান মাড়াই ও শুকানোর জন্য খলা তৈরি কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আবার কেউবা সেই ধান রোদে শুকিয়ে বস্তাবন্দি করে সংরক্ষণ করছেন।
কৃষকরা জানান, বৈশাখের প্রথম দিনে কষ্টের ফলানো সোনালি ধান ঘরে তুলতে পেরে সত্যি খুব আনন্দ লাগছে। এই হাওরকেই ঘিরেই আমাদের স্বপ্ন, আমাদের সুখ।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করেছেন কৃষকরা। যেখান থেকে এই বছর ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০২ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হবে। টাকার অংকে যার বাজারমূল্য প্রায় ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা।
এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলার হাওর পাড়ের কৃষক-কৃষাণী এবং বৃদ্ধ-শিশুসহ সকলই অন্য রকম এক বৈশাখী উৎসব মেতে উঠেছেন। এমনকি এ উৎসবে যোগ দিয়েছেন গ্রামের বাইরে থাকা মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। এই ধান গোলায় তুলতে পারলেই হাওর পাড়ের কৃষকেরা ‘ধনী’। কোনো কারণে গোলায় ধান না উঠলে হাওর পাড়ের মানুষের মন বেদনায় ভরে উঠে এবং তাদের কষ্টের আর সীমা থাকে না। কারণ এই উৎপাদিত বোরো ধান দিয়ে চলে সারাবছরের সংসারের খাবার। আর এই ফসল বিক্রি করে ছেলে-মেয়ে লেখা পড়া , চিকিৎসা, বিয়ে-শাদিসহ সামাজিকতা ইত্যাদি।
সুনামগঞ্জে জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরের কৃষক সমসের আলী বলেন, মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ৭ একর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছিলাম। সেই ধানের বাম্পার ফলন হলেও গত সপ্তাহে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে ধান ঘরে তোলা নিয়ে ছিলাম চরম শঙ্কায়। তবে সেই শঙ্কা কাটিয়ে অবশেষে বৈশাখের ১ম সপ্তাহেই স্বপ্নের ফলানো সেই ধান কেটে মাড়াই দিয়ে প্রখর রোদে শুকাচ্ছি, ফলন ভালো হওয়ায় মহান আল্লার শুকরিয়া আদায় করছি, আলহামদুলিল্লাহ।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরপাড়ের ফেতেপুর গ্রামের কৃষক চাঁন মিয়া বলেন, এবার দশ কেদার জমিতে বোরো চাষ করেছি, আজ এই জমির পাকা ধান কাটা শুরু করছি। এক সময় হাওরে ধান কাটার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিক আসতেন। এখন এটা একবারে কমে গেছে। স্থানীয় ভাবেও শ্রমিক মেলে না। তাই এখন ধান কাটার যন্ত্রের ওপরই ভরসা। কিন্তু হাওরে পানি থাকলে মেশিনে ধান কাটায় সমস্যা হয়।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার আলমপুর গ্রামের কৃষক শুকুর আলী বলেন, দেখার হাওরে ১২ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছি, ধান পাকা শুরু হয়েছে দু’দিন পর ধান কাটা শুরু করবো। আবহাওয়া ভালো থাকলে ৮-৯ দিনে ধান গোলায় তুলে নিবো। একই গ্রামের আরেক কৃষক সহিদ মিয়া বলেন, পুরোদমে ধান কাটা শুরু হতে আরও তিন থেকে চার দিন সময় লাগবে। রোদ ওঠায় সবাই খুশি। এভাবে ১৫ থেকে ২০টা দিন পেলেই হবে।
দিরাই উপজেলার টাঙনির হাওরের কুলঞ্জ এলাকায় হারভেস্টর মেশিনের পরিচালক মাহবুব চৌধুরী জানান, আমাদের এলাকায় পুরোদমে কাটা শুরু হয়েছে। জমিতে পানি থাকায় দিনে ২৫ থেকে ৩০ কেদার জমি কাটা সম্ভব হচ্ছে। এভাবে ১৫ দিন পেলে এই এলাকার সব ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের কাছ থেকে ৭০ ভাগ টাকা ভর্তুকি নিয়ে কেনা জেলার ৮৭৩টি কম্বাইন হারভেস্টারের একটা অংশ গোপনে বিক্রয় হয়েছে অন্য জেলায়। এসব ধান কাটার যন্ত্র স্ব স্ব এলাকায় নেই। কিন্তু কৃষি অফিসের তালিকায় এখনো এই কম্বাইন হারভেস্টারকে দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। কৃষকদের অভিযোগ, কম্বাইন হারভেস্টার কেনা-বেচায় কৃষি অফিসের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ থাকায় তালিকায় এখনো হারভেস্টার দেখানো হচ্ছে।
এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক বিমল চন্দ সোম। তিনি বলেন, কয়েকটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
জানা গেছে, সরকার শতকরা ৭০ ভাগ ভর্তুকি দিয়ে যেসব কৃষি যন্ত্রপাতি কৃষকদের মাঝে বিতরণ করেছে তার উদ্দেশ্য ছিলো এসব মেশিনের মাধ্যমে চাষাবাদ ব্যবস্থার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে উৎপাদনের সংকট দূর করা। ব্যক্তি বিশেষকে লাভবান করার জন্য সরকারের এই কর্মসূচি ছিলো না। কিন্তু শুরু থেকেই এই মহতি কর্মসূচিটি মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে নিজে নিজে লাভবান হওয়ার প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। হাওরাঞ্চলে এখন বোরো ধান কাটার পুরো মৌসুম চলছে। কৃষকরা হন্যে হয়ে হারভেস্টার মেশিনের জন্য ঘুরছেন। কিন্তু কোথাও হারভেস্টার পাচ্ছেন না। বাইরের জেলা থেকে বেশি টাকা খরচ করে এই মেশিন আনার চেষ্টা করেও অনেকে বিফল হচ্ছেন। যে অল্প সংখ্যক হারভেস্টার এখনও জেলার ভিতরে সচল অবস্থায় রয়েছে সেগুলোও ধান কাটার জন্য গলাকাটা মূল্য হাঁকছে।
অথচ কৃষি অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে জেলায় এ পর্যন্ত ৮৭৩টি হারভেস্টার ভর্তুকিমুল্যে বিতরণ করা হয়েছে। এসব মেশিন সচল থাকলে এখন ধান কাটার জন্য মেশিনের বিন্দুমাত্র সংকট থাকার কথা নয়। একেবারে নামমাত্র মূল্যে হারভেস্টার মেশিনগুলো কিনে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা তা অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এই বিক্রির সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। ধারণা করা হচ্ছে অধিকাংশ হারভেস্টারই অনুরূপভাবে বেহাত হয়ে জেলার বাইরে চলে গেছে।
বিষয়টির খোঁজ নিতে কয়েকটি হারভেস্টার ক্রেতাদের কৃষি অফিসে দাখিলকৃত মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে অধিকাংশ মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। কিছু সংখ্যক মোবাইল নম্বর সচল থাকলেও ওপ্রান্তে কেউ ফোন ধরেননি। অভিযোগ আছে ভুয়া মোবাইল নম্বর ব্যবহার করেও অনেকে হারভেস্টার গ্রহণ করেছেন।
জানা গেছে, একটি কম্বাইন হারভেস্টারের বাজার দর ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা। ব্র্যান্ড ভেদে এর চাইতেও বেশি দামের হারভেস্টার রয়েছে। ১৫ লাখ টাকার একটি হারভেস্টার সরকার কৃষকদের নিকট বিক্রি করছে (শতকরা ৩০ ভাগ মূল্য) সাড়ে ৪ লাখ টাকায়। অবশিষ্ট সাড়ে ১০ লাখ টাকা সরকার পরিশোধ করছে। এতবড় একটি কৃষকবান্ধব কর্মসূচি ঘিরে শুরু থেকেই একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠে। কৃষি অধিদপ্তর থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও মাঠ পর্যায়ের ক্রেতা-কৃষক পর্যন্ত নানা ব্যক্তি এই সিন্ডিকেটের অংশ। প্রথমেই নিম্নমানের মেশিন কিনে বেশি দাম দেখিয়ে কৃষকদের নিকট বিক্রি করা হয়। এসব মেশিন অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে পড়ে বলে ভুক্তভোগী কৃষকরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে কিছু ক্রেতা এগুলো কম দামে কিনে বাইরে বিক্রি করে দিয়ে মুনাফার টাকা স্থানীয় কৃষি অফিসের কিছু অসৎকর্মচারীসহ ভাগবাটোয়ারা করে নেন। এই দুষ্টচক্রের কারণে ধানকাটার সময় হারভেস্টারের প্রকট সংকট দেখা দিয়েছে।
কৃষকরা অভিযোগ করেন- কৃষি অফিসের দায়িত্বে ছিলো এপ্রিল মাসের আগেই সবগুলো হারভেস্টারের খোঁজখবর নিয়ে সচল করার ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এই খোঁজখবর নিতে গেলেই অবৈধ বিক্রির তথ্য বেরিয়ে আসে। কিন্তু কৃষি অফিসগুলো নাকে সরিষার তেল মেখে লম্বা ঘুম দিয়ে সময় পার করছেন। এই শিথিলতার কারণেই যাবতীয় অনিয়ম ঘটে থাকে।
কৃষকদের দাবী- জেলায় বিতরণকৃত কম্বাইন হারভেস্টরের কতগুলো প্রকৃত অর্থে অকেজো, কতগুলো সচল এবং কতগুলো অবৈধভাবে বিক্রি করা হয়েছে তার নির্দিষ্ট তালিকা করা উচিত। একই সাথে যারা অবৈধভাবে মেশিন বিক্রি করেছেন তাদের নিকট থেকে বিধি মোতাবেক ভর্তুকির টাকা আদায় করে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে। এই কাজ করা না হলে সরকারি কোনো প্রকল্পেই শৃঙ্খলা ধরে রাখা কঠিন হবে। সরকার হাজার কোটি টাকা ভর্তৃুকি দিবেন আর কিছু লোক মুফতে এর সবকিছু লুটেপাটে খাবে এমন সর্বনাশা প্রশাসনিক সংস্কৃতিকে অবশ্যই নির্মূল করতে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
দিরাই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মনোরঞ্জন অধিকারী দৈনিক জালালাবাদকে জানান, মঙ্গলবার পর্যন্ত হাওরে ৫৭ ভাগ পাকা ধান কাটা হয়েছে। দিরাই উপজেলায় বিভিন্ন হাওরে নিজস্ব ১২৩ টি ও বাহির থেকে আসা প্রায় ২০ টি মেশিনে প্রতিদিন ধান কাটা হচ্ছে। সরকারিভাবে ধান কাটার পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয়নি, জমির মালিক ও মেশিনের মালিক আলোচনা সাপেক্ষে টাকা নির্ধারণ করে ধান কাটছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম দৈনিক জালালাবাদকে বললেন, এবার সুনামগঞ্জের ২ লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমি থেকে ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২১০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে হাওর এলাকার ৫০ ভাগ জমির ধান কাটা হয়ে গেছে। জেলায় পর্যাপ্ত হারভেস্টর রয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে হারভেস্টার যন্ত্রের বিষয়ে কড়া নজরদারি রয়েছে। সকল কম্বাইন হারভেস্টার বিধি মোতাবেক কেনা হয়েছে। হারভেস্টার যন্ত্রের মালিকরা ৩ বছর পর মালিকানা হস্তান্তর করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভুর্তকির টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিতে হবে। কৃষি অফিসকে বিষয়টি জানিয়ে হস্তান্তর করতে হবে। কম্বাইন হারভেস্টার সংশ্লিষ্ট এলাকায় নেই, অথচ তালিকায় দেখানো হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমরা খোঁজ নিচ্ছি। সত্যতা পেলে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সুনামগঞ্জের প্রধান প্রকৌশলীর মামুন হাওলাদার দৈনিক জালালাবাদকে জানান, সামনের দিনগুলোতে বৃষ্টিপাতের আভাস থাকলেও ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত জেলায় আগাম বন্যা ও পাহাড়ী ঢলের শঙ্কা নেই।