বিদেশী ঋণ শোধের চাপে সরকার
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ৬:৫৮:৪২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : রিজার্ভ সংকট, রাজস্ব আহরণ, রফতানি আয়, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বড় চাপে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। এই সংকটের মধ্যে মাথাব্যথ্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের চাপ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং আসল পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৯৪ শতাংশ সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে। এ ছাড়া নতুন পাওয়া ঋণের ৫৪ শতাংশ যাচ্ছে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ পরিশোধে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০১৫ সালে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পর থেকে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া কমিয়ে দেয় উন্নয়ন সহযোগীরা। ফলে তুলনামূলক কঠিন শর্তে এবং স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতে হয় সরকারকে। এসব ঋণের সুদহারও ছিল কয়েকগুণ বেশি। এ সময়ে যেসব বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার অনেকগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে বা শেষের পর্যায়ে আছে। ফলে আমাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী কয়েক বছর বাড়তে থাকবে। রিজার্ভ সংকট এবং টাকার অবমূল্যায়ন ঋণ শোধে চাপ সৃষ্টি করেছে।
সরকারের বৈদেশিক ঋণের দেখভাল করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। তাদের চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ মেয়াদে বৈদেশিক ঋণের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম ৯ মাসে সরকার সুদ ও আসলসহ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার। টাকার অঙ্কে ২৮ হাজার ২৮১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এটি এখন পর্যন্ত পরিশোধ করা সর্বোচ্চ বিদেশি ঋণ। এর আগে ৯ মাসে এত ঋণ পরিশোধ করেনি সরকার। ঋণ পরিশোধ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নকে দায়ী মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের হার ছিল ১ দশমিক ১৭৭ শতাংশ। পরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে একলাফে টাকার অবমূল্যায়ন বেড়ে ২৬ দশমকি ১২ শতাংশে দাঁড়ায়। এতে প্রতি ডলারের দর হয় ১০৮ টাকা ৮৪ পয়সা। চলতি অর্থবছরের ৭ মাসে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১ দশমিক ০৬ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা। অর্থাৎ গত দেড় বছরে ২৭ শতাংশের বেশি টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে।
২৭ শতাংশ টাকার অবমূল্যায়নের অর্থ হলো যেখানে ২০২৩ সালে ১০০ টাকায় ১ ডলার পাওয়া যেত, সেখানে বর্তমানে ১ ডলার কিনতে ১২৭ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ডলারের কিনতে অতিরিক্ত ২৭ টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে সরকার ঋণের আসল পরিশোধ করেছে ১৬ হাজার ৬৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিশোধ করা হয়েছিল ১২ হাজার ২০২ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ঋণের সুদ পরিশোধ করেছে ১১ হাজার ৬০১ কোটি কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৪৩ দশমকি ৬৯ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪ হাজার ৭৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে নতুন যে ঋণ পাওয়া গেছে তার ৫৪ শতাংশ ব্যয় হয়েছে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বিদেশি ঋণের অর্থছাড় হয়েছে ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে অর্থছাড় বেড়েছে ২৬ কোটি ৮৬ লাখ ডলার।
অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে এডিবি। এ সংস্থা অর্থছাড় করেছে ১৪০ কোটি ২৭ লাখ ডলার। জাপান ছাড় করেছে ১৩৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এরপর বিশ্বব্যাংক ছাড় করেছে ৯৬ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। এ ছাড়া রাশিয়া ৮০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার এবং চীন ৩৬ কোটি ১৭ লাখ ডলার ছাড় করেছে। ভারত দিয়েছে ১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। বাকিগুলো অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, উন্নয়ন সহযোগীরা এ সময়ে ৭২৪ কোটি ২১ লাখ ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩০৭ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে ৪১৬ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।
এদিকে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে বাজেটে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। অর্থবছরের ৯ মাসেই এই বরাদ্দের প্রায় ১১ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বা প্রায় ৯৪ শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। অর্থবছরের বাকি আছে আরও ৩ মাস। অবশিষ্ট যে বরাদ্দ আছে তা দিয়ে ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয়। এ জন্য সংশোধিত বাজেটে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নি¤œমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পর সহজ শর্তের ঋণ প্রাপ্তি কমে যায়। বিপরীতে তুলনামূলক কঠিন শর্তের ঋণ বৃদ্ধি পায়। এসব ঋণের গ্রেস পিরিয়ড কম থাকার পাশাপাশি সুদও বেশি ছিল।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের আওতায় নেওয়া অনেকগুলো ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে বা শেষ পর্যায়ে আছে। ফলে আমাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী কয়েক বছর বাড়তে থাকবে। এ সময়ে টাকার বিনিময় হারের বড় ধরনের অবনমন হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দিক থেকে আমরা ত্রিমাত্রিক চাপে আছি। সামনে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে।