দাবদাহে বাধাগ্রস্ত জীবনযাত্রা
প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১০:০৯ অপরাহ্ন
* চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ ডিগ্রী তাপমাত্রা *২মে পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ
জালালাবাদ রিপোর্ট: মধ্যে বৈশাখী ঝড়ে শীতল হয়ে যেত ধরণি। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। চার সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ভয়ংকর দাবদাহ বয়ে যাচ্ছে দেশে। যা ইতিমধ্যে ৭৬ বছরের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। দেশে তীব্র উষ্ণতা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বাধাগ্রস্ত করছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, কমছে কর্মক্ষমতা।গত পরশু রোববার ১১ অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রির ওপরে। সোমবার প্রায় ১৭ অঞ্চলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে উঠে গেছে। একইভাবে ঢাকার তাপমাত্রা আবারও ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে।
এই তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষ। নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। বেশি সময় স্বাভাবিক কর্মজীবনে থাকতে পারছেন না খেটে খাওয়া মানুষ। রোজগারে সংকট তৈরি হওয়ায় অভাবে পড়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। হিটস্ট্রোকে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন।
চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে রোববার হিট স্ট্রোকে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি এই মৌসুমে একদিনে মৃত্যুর রেকর্ড বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।এ অবস্থায় তাপপ্রবাহ আরো বেড়েছে। টানা দাবদাহের মধ্যে সোমবার দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪৩ ডিগ্রী তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
আর ২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ওঠে ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।বাংলাদেশে মে মাসেও গরমের দাপট যে বেশি থাকে, সে কথা তুলে ধরে ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফি অ্যান্ড মেরিটাইম ইন্সটিটিউটের (এনএওএমআই) সাবেক চেয়ারম্যান ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেন, ১৯৭২ সালে এই মে মাসেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল রেকর্ড ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শেষ তিন দশকে বাংলাদেশের আবহাওয়া আগের তুলনায় উষ্ণ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টিপাত ও শীতের দিন কমছে, বছরের বড় অংশজুড়ে গরমের বিস্তার বাড়ছে। গড় তাপমাত্রা বেড়ে এপ্রিল মাস আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলছেন, “জলীয়বাষ্প পুঞ্জীভূত হয়ে বৃষ্টি হওয়ার কথা। সেটি পুঞ্জীভূত না হয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। এ কারণেই গরম বেশি পড়ছে।” আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, আগামী দুই দিন তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে পারে এবং আগামী সপ্তাহে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। বৃষ্টিপাত হওয়ার পর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নামবে।
এদিকে, দেশে বহমান প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের বিদ্যালয় ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর লার্নিং সেন্টার আগামী বৃহস্পতিবার (২ মে) পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।তাপপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার ক্লাস বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টও। শিক্ষাসচিব এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে শিক্ষকসহ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন প্রতিবেদন নজরে আনা হলে শুনানি নিয়ে সোমবার বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত এ আদেশ দেন।
তবে হাওর-বাওরের সিলেট তুলনামুলক স্বস্তিতেই ছিলো গতকালও। সিলেটে সোমবার তাপমাত্রা ছিলো ৩২ ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। রোববার সিলেটে কালবৈশাখীও তা-ব চালায়। ঝড়ে কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়ায় রেললাইনের ওপর গাছ পড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ৩ ঘন্টা পর চালু হয় ট্রেন চলাচল।
এদিকে, এখন চলছে আম, কাঁঠাল ও লিচুর মৌসুম। মাঠে মাঠে দুলছে পরিপুষ্ট ধান। এমন সুসময়ে কৃষকের কপালে চিন্তারেখা এঁকে দিয়েছে প্রবল গরম। মাথার ওপর গনগনে সূর্য প্রকৃতির বুকে যেন আগুন ঢালছে। সকাল থেকেই তপ্ত থাকছে ফসলের মাঠ। খরার কারণে আম-লিচুর গুটি শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে যাওয়ায় কোথাও কোথাও নলকূপেও উঠছে না পানি।
এছাড়া বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, পটোল, শসা ও ঢ্যাঁড়স ক্ষেতে তিন-চার দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। পাতা জাতীয় সবজি যেমন ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, কলমি ও লাউশাক ক্ষেতে দু-তিন দিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার দীর্ঘ খরায় হুমকির মুখে পড়তে পারে ফসল উৎপাদন। এতে করে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবিলা করাই হবে উত্তরের কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলেই ধানে চিটা হতে পারে। সেখানে এবার তাপমাত্রা ৩৯ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় ধানে ফুল অবস্থায় পানি খুব গুরুত্বপূর্ণ।