হাওরজুড়ে শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মে ২০২৪, ৫:০০:০৬ অপরাহ্ন
দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক
এমজেএইচ জামিল সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে : একদিকে গরমের তীব্রতায় পুড়ছে দেশ। অন্যদিকে খরা রোদে হাওর জুড়ে চলছে বৈশাখের উৎসব। মাড়াই খলা থেকে শুরু করে কৃষকের বাড়ি সর্বত্র সোনালী ধানের মনমাতানো ঘ্রাণ। ধান কাটা প্রায় শেষ হওয়ায় সেদ্ধ ও শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকের। এ বছর ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি।
তবে উৎসবের মাঝে কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে ধানের মূল্য। উৎপাদন খরচ বেশী হওয়ায় ধানের মূল্যবৃদ্ধির দাবী জানান তারা। সরকারীভাবে ধানের মণ ১২০০ টাকার উপরে নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে ধান বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকা মণ। এই দামে ধান বিক্রি করে লোকসানের মুখে পড়ছেন হাজার হাজার কৃষক।
কৃষি বিভাগের মতে বৃহস্পতিবার (২ মে) পর্যন্ত হাওরাঞ্চলে ৯৯ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। দুয়েকদিনের মধ্যেই শতভাগ কাটা শেষ হয়ে যাবে। তবে ননহাওরে এখন পর্যন্ত ধান কাটা হয়েছে ৫৩ শতাংশ।
সরেজমিনে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং রোগবালাই কম হওয়ায় বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বৃষ্টির আগেই গোলায় তুলতে হবে ধান, এই লক্ষ্যে তীব্র রোদ মাথায় নিয়েই মাঠে মাঠে ও কৃষকের বাড়ি বাড়ি পুরোদমে চলছে ধান কাটা ও মাড়াই-ঝাড়াইয়ের কাজ। কৃষকদের সঙ্গে কৃষাণিরাও সমানতালে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। যেদিকে দৃষ্টি যায় শুধু ধান আর ধান। নতুন ধানের গন্ধে মাতোয়ারা পুরো হাওরাঞ্চল। কৃষকরা এখন মাড়াই-ঝাড়াই, সেদ্ধ ও শুকানোসহ বোরো সংগ্রহে ব্যস্ত, বিশ্রামেরও ফুরসত নেই যেন তাদের।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরে দেখা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে ধান কেটে গোলায় তোলার উৎসব প্রায় শেষ প্রান্তে ঐ এলাকার মানুষ। সকাল থেকে দিনভর ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুসহ সকলে।
জানা গেছে, জেলার ছোট-বড় ১৩৭ টি হাওরে ধান কাটা প্রায় শেষের দিকে। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ ধান কাটা শেষ হয়েছে। তবে শেষ সময়ে কৃষকরা পড়েছেন কিছুটা দুঃশ্চিন্তায়। আজ শুক্রবার (৩ মে) থেকে হাওর এলাকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। একই সাথে বৃহস্পতিবার থেকে পাহাড়ী ঢল নামতে শুরু করেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আজ (৩ মে) থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকায় (সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনা) ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায়, হাওড় এলাকার ফসল রক্ষায় বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি বিভাগ।
নিদের্শনা মতে, বোরো ধান ৮০ শতাংশ পরিপক্ক হয়ে গেলে দ্রুত সংগ্রহ করে নিরাপদ ও শুকনো জায়গায় রাখতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া দ্রুত পরিপক্ক সবজি সংগ্রহ, কলা ও অন্যান্য উদ্যানতাত্বিক ফসল এবং সবজির জন্য খুঁটির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষি জমির নিষ্কাশন নালা পরিষ্কার, ধানের জমিতে পানি জমতে না দেয়া, জমির আইল উঁচু করা, ফসলের জমি থেকে অতিরিক্ত পানি সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা রাখতেও কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বৃষ্টির সময় সেচ, সার ও বালাইনাশক না দেয়া এবং বৃষ্টির পর বালাইনাশক প্রয়োগেরও পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে দিন-রাত এক করে কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন। কেউ ধান কাটছেন, কেউ আঁটি বাঁধছেন। কেউ কেউ সেই ধান মাথায় নিয়ে ক্ষেত থেকে বাড়ি যাচ্ছেন। আবার কেউ করছেন মাড়াইয়ের কাজ। সকাল থেকে দিনভর এভাবেই ব্যস্ত সময় পার করছেন সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষাণ-কৃষাণীরা।
তবে সোনালী ধান ঘরে তোলার পরও কৃষকের মুখ যেন মলিন হয়ে আছে। কারণ ধানের ফলন ভালো হলেও সার, কীটনাশক, ধান কাটা শ্রমিকসহ অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়েছে। খরচের তুলনায় ধানের দাম কম। ফলে ধানের দাম না বাড়লে লাভতো দূরে থাক এই দামে উৎপাদন খরচও উঠবে কি না তা নিয়ে এখন শঙ্কায় কৃষক।
হাওর পাড়ের কৃষকরা জানান, সবকিছুর যে দাম তাতে ধানের দাম ১৩শ থেকে ১৪শ টাকার নিচে হলে কৃষকের লোকসান। যেভাবে খরচ হয়, তাতে কৃষকের বেঁচে থাকা সম্ভব না।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরের কৃষক আব্দুর রব মিয়া জানান, এই বছর ধানের আবাদ করতে অন্যান্য বছর থেকে বেশি খরচ হয়েছে। সেই তুলনায় দাম আরও বেশি নির্ধারণ করলে ভালো হতো।
দেখার হাওরের কৃষক ফরহাস আলী বলেন, এই বছর হাওরে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কৃষকরা হাসিমুখে ধান ঘরে তুললেও ধানের দাম নিয়ে শঙ্কায় আছেন কৃষকরা। সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করেছে সেই দামে কৃষকরা দান বিক্রি করতে পারছেন না।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ১৩৭টি ছোটবড়ো হাওরে বোরোচাষে জড়িত প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার চাষী পরিবার। এবার হাওরে বোরোচাষ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর। এর মধ্যে ৭০.০৫ ভাগ উফশী (উচ্চ ফলনশীল ধান), ২৯ ভাগ হাইব্রিড ধান ও ০.০৫ ভাগ স্থানীয় প্রজাতির দেশি ধান আবাদ হয়েছে। গতকাল ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত কর্তন হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার হেক্টর। যা চাষাবাদের প্রায় সাড়ে ১৭ ভাগ।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে হাওরে ধান কাটতে ৮৭০টি কম্বাইন হার্ভেস্টর ও ২০০টি রিপার যন্ত্রের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন গড়ে একটি হার্ভেস্টর ১শ জন শ্রমিকের ও রিপার ২০ জন শ্রমিকের ধান কাটতে পারে। কৃষি বিভাগের মতে হাওরে ১ লাখ ৯০ হাজার নিয়মিত কৃষি শ্রমিক, ৩০ হাজার অনিয়মিত শ্রমিক ও বাইরের জেলার আরো প্রায় ১০ হাজার শ্রমিকসহ প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিকও ধান কাটছেন। সর্বশেষ তথ্যমতে জেলায় ৯৯ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে।
কৃষি বিভাগ আরও জানিয়েছে, এবার হাওরে বিআর ২৮, ২৯ বীজ দেওয়া হয়নি সরকারিভাবে। তাই হাওরে ৮৯, ৯৬, ৮৮, ৯২, বঙ্গবন্ধু-১০০ ধানের আবাদ হয়েছে বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন প্রকৃতি এভাবে ১৫দিন অনুকূলে থাকলে হাওরের শতভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। হাওরের পুরো ধান কৃষক গোলায় তুলতে পারলে গত বারের চেয়ে এবার আরো ১১০ কোটি টাকার বেশি ধান উৎপাদিত হবে। গত বছর ৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৪৯ মে.টন চাল উৎপাদিত হয়েছিল। এবার ৯ লক্ষ ১৩ হাজার মে. টন চাল উৎপাদিত হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে কৃষকেরা যাতে হাওরের ফসল নির্বিঘ্নে গোলায় তুলতে পারেন, এ জন্য যা যা করা দরকার, জেলা প্রশাসন সহ কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, যথাসময়ে বৃষ্টি পাওয়ায় এবারও বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই গতবারের চেয়ে এবার উৎপাদনমূল্যও বেশি হবে। শ্রমিকের সংকট নেই। ধান কাটাও শেষ পর্যায়ে, আশা করছি আজ-কালের মধ্যেই শতভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার (২ মে) পর্যন্ত হাওরে ৯৯ ভাগ ও ননহাওরে ৫৩ ভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। হাওরে দুয়েকদিনের মধ্যেই শতভাগ শেষ হবে। ননহাওরে জমির সংখ্যা অনেক কম এবং বড় বন্যা না হলে কিছু দেরী হলেও এসব ধান ঢুবে যাওয়ার শঙ্কা নেই। এবছর সুনামগঞ্জ জেলায় ১৩ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন ধান এবং ৯ লক্ষ ১৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন চাল ঘরে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২ মে পর্যন্ত ১২ লক্ষ ৩ হাজার মেট্রিক টন ধান ও ৮ লক্ষ ২হাজার ৪২২ মেট্রিক টন চাল তোলা হয়ে গেছে।