জলবায়ু বৈরিতায় বজ্রপাত বাড়ছে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মে ২০২৪, ৭:২৫:১৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে বজ্রপাতের ঘটনা বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে; বৃদ্ধি পাচ্ছে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার পরিধিও। দেশের যেসব অঞ্চলে আগে খুব একটা বজ্রপাত হতো না, এখন সেসব অঞ্চলে বজ্রপাত বেড়ে গেছে। গ্রীষ্মম-লীয় এ দেশে বেড়ে গেছে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার ‘বৈপরীত্যের’ কারণে গত দুই বছরে পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটেছে। এখন পাহাড়ি অঞ্চলেও বজ্রপাতের ঘটনা কিংবা প্রাণহানি আগের চেয়ে বেশি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত দুদিনে দেশে বজ্রপাতে অন্তত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবারই ১১ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে কুমিল্লায় চার, রাঙ্গামাটিতে তিন, কক্সবাজারে দুই এবং খাগড়াছড়ি ও সিলেটে একজন করে মারা গেছেন।
দেশের হাওর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সাধারণত বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সম্প্রতি অন্যান্য জেলায়ও বজ্রপাত বাড়ছে। দুর্যোগ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাবে বেশির ভাগ দুর্যোগই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা স্থানভেদে ১২-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এসব দুর্যোগের মধ্যে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি।বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষার আগে অর্থাৎ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশের আবহাওয়া সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত থাকে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে এ সময় অনেক জলীয় বাষ্প তৈরি হয়। এ জলীয় বাষ্পই বজ্রপাতের প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে। জলীয় বাষ্প যত বেশি হবে, তত বেশি বজ্র মেঘের সৃষ্টি হবে এবং ঘন ঘন বজ্রপাত দেখা যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় দেখা গেছে, ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ১২ শতাংশ বজ্রপাত বাড়ছে। এটা সবস্থানে একই রকম। ২০১০-২৪ সাল পর্যন্ত ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়েছে।’
ড. মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চলের তাপমাত্রা এখনকার মতো ছিল না। তাপমাত্রা বেড়েছে। ফলে বজ্রপাতও বেড়েছে। যেসব জায়গায় বজ্রপাত আগে থেকেই বেশি, সেসব জায়গায় এখন আরো বেশি হবে। আর যেসব অঞ্চলে কম ছিল, সেখানে বাড়বে। এই তাপমাত্রা চলমান থাকলে বছরে ৫০ শতাংশ বেশি বজ্রবৃষ্টি হবে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে গত সাত বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েছে। গত বছর ৫৬ জেলায় বজ্রপাতে ৩১৮ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় অর্ধশতাধিক। এর আগের বছরও প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ২০১, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৫ সালে ২২৬, ২০১৬ সালে ৩৯১, ২০১৭ সালে ৩০৭, ২০১৮ সালে ৩৫৯, ২০১৯ সালে ১৯৮, ২০২০ সালে ২৫৫ এবং ২০২১ সালে ৩১৪ জনের মৃত্যু হয়।
দেশের ১৬টি জেলায় বজ্রপাত ও মৃত্যু বেশি। এ তালিকায় রয়েছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জামালপুর, গাইবান্ধা ও টাঙ্গাইল।
অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দুই বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় ও পাহাড়ি অঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যশোর, বরিশাল, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, শরীয়তপুর, রাঙ্গামাটি, সাতক্ষীরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কুমিল্লা, খুলনা, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি। দেশে ১৯৯০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যু হয় ৫ হাজার ৬০০ জনের। এর মধ্যে গত সাত বছরে মৃত্যুর হার বেশি। আমেরিকান মেট্রলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত ‘লাইটিং ফ্যাটালিটিস ইন বাংলাদেশে ফ্রম ১৯৯০ থ্রু ২০১৬’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, বাংলাদেশে সকাল ও দুপুরের বজ্রপাতে সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যক্তি মারা গেছেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। যেসব কারণে বজ্রপাত হয়, সেসব কারণ এ সময়ে বেশি বিদ্যমান থাকে।
গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, গত ২৬ বছরে বজ্রাঘাতে মারা যাওয়া ৩ হাজার ৮৬ জনের ৯৩ শতাংশ গ্রামের বাসিন্দা। তারা মূলত কৃষিকাজে যুক্ত। ২০১১ সালের আগে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে বছরে গড়ে দশমিক নয়জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। ২০১১-১৬ সাল পর্যন্ত এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৮ জনে।
দেশে বজ্রপাতকে ২০১৬ সালে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে, দুর্যোগ ঘোষণার পর বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হয়। প্রতিরোধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। এ কার্যক্রম চলমান। এরই মধ্যে কিছু লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবীক্ষণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ) নিতাই চন্দ্র দে সরকার বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে আবহাওয়া বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। এল-নিনোর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। শীতের সময় শীতও বেশি দেখা যায়নি। এল-নিনোর পর লা-লিনোর প্রভাব আসবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ বছর বজ্রপাতের সংখ্যা আরো বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে কম-বেশি প্রায় ৫০ জেলায় বজ্রপাত দেখা যায়। যেসব জেলায় কম বজ্রপাত হতো, সেসব জায়গায় বেশি হচ্ছে। সবসময় এক জায়গাই বেশি হচ্ছে—এমনটি নয়। আগে ফরিদপুরে বেশি হতো, এখন সেখানে কম হচ্ছে। পাহাড়ে বিক্ষিপ্তভাবে বজ্রপাত হতো, এখন সেখানে বেশি দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হতে পারে সেখানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
তিনি জানান, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা জানা গেলেও বজ্রপাতের সংখ্যা জানা যায় না। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে এরই মধ্যে ১৫ জেলায় ৩৬০টি লাইটনিং অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে। যার মাধ্যমে কখন, কোন জায়গায় বজ্রপাত হয়েছে তা জানা যায়। আমরা আরো একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছি যেখানে ৬০০টি মেশিন বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত ২৫ বছরে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তামপাত্রা বৃদ্ধি বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। জলোচ্ছ্বাস, আকস্মিক বন্যা ও হারিকেনের পর আবহাওয়াসংক্রান্ত কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে বজ্রাঘাতে।
জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বজ্রপাত দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত সপ্তাহে হংকংয়ে এক রাতে ১০ হাজার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে বলে আমরা জেনেছি। বজ্রপাতে যারা আহত হচ্ছেন তারা বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। হৃদরোগ, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, স্নায়বিক সমস্যা, পুড়ে যাওয়া, চোখের ক্ষতি ও পেশির ক্ষতি হতে পারে। পেশির ক্ষতি হলে ইউরিনের সমস্যার কারণে কিডনিতে প্রভাব পড়তে পারে। প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ভয়ের কারণে ট্রমাক্রান্ত হতে পারেন। বাংলাদেশে বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করলেও স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়নি। এটা প্রয়োজন। বজ্রপাত প্রতিরোধে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। জনসচেনতাও প্রয়োজন।’