হাওরে উঠছে ২শ কোটি টাকার খড়
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ মে ২০২৪, ৪:৪৮:১০ অপরাহ্ন
খাদ্য মজুদ হবে ৮ লাখ গবাদি পশুর
এমজেএইচ জামিল সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে : তাপপ্রবাহের মতো বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও এবার আনন্দচিত্তে বৈশাখী তুলেছেন হাওরপারের কৃষকেরা। খরায় ধান কেটে তোলার পাশাপাশি অনায়াসে গবাদি পশুর খাদ্য খড়ও তুলেছেন তারা। ধান কাটা শেষ হওয়ায় এবার গো খাদ্য তোলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। এবার জেলার ৮লাখ গবাদি পশুর জন্য হাওরে উঠছে সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন খড়। যার বাজার মূল্য ২ শত কোটি টাকার উপরে।
জানা গেছে, কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম পাহাড়ি ঢলের ভয় ও শঙ্কাহীন উৎসবমূখর পরিবেশে বৈশাখ মাস পার করছেন হাওরপারের মানুষ। এবার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ধান পেয়েছেন সুনামগঞ্জের কৃষকরা। সেই বোরো ধান শুকিয়ে গোলায় তুলছেন তারা। প্রখর রৌদ্র থাকায় ধান শুকানোর পাশাপাশি গো-খাদ্য খড় সংগ্রহে দিনরাত ব্যস্ত হাওরের কৃষক পরিবারের লোকজন। এবছর জেলায় ২০০ কোটি টাকার খড় সংগ্রহের আশা করছে প্রাণি সম্পদ বিভাগ। যা থেকে হাওরাঞ্চলের ৮ লাখ গবাদি পশুর এক বছরের খাদ্য মজুদ হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনও হাওরের কৃষি নির্ভরশীল গবাদি পশুর উপর। চলতি বছর ৯ শতাধিক হার্ভেস্টার যন্ত্র দিয়ে হাওরের বোরো ধান দ্রুত কর্তন ও মাড়াই এক সঙ্গে হওয়ায় ধান সংগ্রহে কৃষকের সময় ও কষ্ট কম হলেও এবার গবাদি পশুর খাদ্য সংগ্রহ নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন। গবাদি পশুর খাবার প্রাকৃতিকভাবে হাওরের খড় থেকে সংগ্রহ করেন কৃষকগন। যা মাড়াই শেষে সংগ্রহ করে থাকেন। কিন্তু এবার বেশির ভাগ এলাকায় হার্ভেস্টারে ধান কর্তন ও মাড়াই করার কারণে সহজে গোখাদ্য সংগ্রহ করতে পারছেন না কৃষক। যার ফলে কৃষকদের ধান কর্তনের পর আলাদা ভাবে শ্রমিক দিয়ে খড় সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতে তাদের বাড়তি অর্থ লাগছে এবং খাদ্য হিসেবে খড় প্রস্তুত করতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। গোখাদ্য সংগ্রহ করে বাড়ির উঠানে খড়ের গম্বুজ (ভোলা) বানিয়ে রাখছেন তারা।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে- সুনামগঞ্জ জেলায় এবার প্রায় ৪ লাখ কৃষক পরিবার ছোট বড় ১৫০টি হাওরে বোরো ধানের চাষাবাদ করেছিল। এবছর জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর। হাওরে ধান কাটতে ৮৭০টি কম্বাইন হার্ভেস্টর ও ২০০টি রিপার যন্ত্রের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক। প্রতিদিন গড়ে একটি হার্ভেস্টার ১শ জন শ্রমিকের ও রিপার ২০ জন শ্রমিকের ধান কাটতে পারে। হাওরে ১ লাখ ৯০ হাজার নিয়মিত কৃষি শ্রমিক, ৩০ হাজার অনিয়মিত শ্রমিক ও বাইরের জেলার আরো প্রায় ১০ হাজার শ্রমিকসহ প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিকও ধান কাটছেন। সর্বশেষ তথ্যমতে জেলায় ৯৯ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। তবে হার্ভেস্টারে ধান কাটতে গিয়ে প্রাকৃতিক গো-খাদ্য (খড়) সংগ্রহের সুযোগ খুব একটা বেশী থাকে না। এছাড়া এবার হাওরে জলাবদ্ধতা থাকায় বেশী পানির কারণে হার্ভেস্টারে ধান কাটার পর অনেক জায়গায় খড় তোলা সম্ভব হয়নি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস জানায়, যুগ যুগ ধরে হাওরের ধান কাটা শেষে ৪ লাখ মেট্রিক টন খড় উৎপাদনে এই অঞ্চলের প্রায় ১০ লক্ষাধিক গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই খড়ের মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক খড় খাইয়ে চাষাবাদের গবাদিপশুকে বর্ষার পুরোটা সময় বাঁচিয়ে রাখেন কৃষকরা। কোন কারণে হাওরের ফসল ডুবি হলে গোখাদ্যের চরম সংকট দেখা দেয় হাওরে। গত বছরের এপ্রিলেও পাহাড়ি ঢলে বেশ কয়েকটি হাওরে ফসলহানি ঘটে। এরপর ২০২২ সালের জুন মাসের ভয়াবহ বন্যায় গোলায় রাখা ধানও নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও অধিকাংশ কৃষকের গো-খাদ্য নষ্ট হয়। ফলে গোখাদ্য কিনে পশুকে বাচিঁয়ে রাখেন তারা।
সাংহাই হাওর পাড়ের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, এবার হাওরের ধান কাটা ও মাড়াই সহজ হলেও যন্ত্রে খড় সংগ্রহের কোন সুযোগ ছিলনা। খড় সংগ্রহ করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। মেশিনে ধান কাটার পর নতুন করে শ্রমিক লাগিয়ে ক্ষেত থেকে খড় সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে এবং খড়ের গুণও থাকছে না।
দেখার হাওরের কৃষক আবলুছ মিয়া বলেন, বৈশাখে ধানের সংগ্রহের পাশাপাশি খড় সংগ্রহ করি উৎসবের মাধ্যমে। এবার এই সুযোগ নেই। যন্ত্রে ধান কাটায় আমাদের খড় সংগ্রহের সুযোগ বাঁধা গ্রস্থ হয়েছে। কিছুই করার নাই তাই শ্রমিক দিয়ে খড় সংগ্রহ করছি। ধান তোলার কাজ শেষে এবার গোখাদ্য খড় উত্তোলনে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মো: রফিকুল ইসলাম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের বৈশাখ ছিল হাওরপারের মানুষের জন্য উৎসবমূখর। খরা রোদ থাকায় নিজেদের খাবার ধান তোলার পাশাপাশি গবাদি পশুর খাবার খড় নির্বিঘ্নে তুলেছেন তারা। কিছু জায়গায় জলাবদ্ধতাজনিত কারণে খড় নষ্ট হলেও সেটা তুলনায় অনেক কম।
তিনি বলেন, জেলায় এবার সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন খড় উঠেছে। এর বাজার মূল্য ২০০ কোটি টাকার উপরে। যা দিয়ে বর্ষা মৌসুমে জেলার ৫ লক্ষাধিক গরু-মহিষ, ১ লাখ ৩৫ হাজার ভেড়া ও ৫২ হাজার ছাগলসহ ১ লক্ষাধিক অন্যান্য গবাদি পশুর খাদ্যের জোগান দেয়া হবে। জলাবদ্ধতা ও যন্ত্রে ধান কাটায় খড় কিছুটা নষ্ট হয়েছে। তবে শেষ সময়ে দিন ভাল থাকায় কৃষকগণ চাহিদামত খড় সংগ্রহ করেছেন। ধান তোলা শেষে আরও কয়েক দিন তারা খড় সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাবেন।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতা ওবায়দুল হক মিলন বলেন, যন্ত্র দিয়ে ধান কাটার ফলে খড় সংগ্রহ করা হাওরের কৃষকের জন্য একটি নতুন সংকট। যাদের গবাদি পশু আছে তারা গরুর জন্য খড় সংগ্রহ করছেন ধান তোলার পাশাপাশি। এখন হাওর এলাকার কৃষকগণ গো খাদ্য খড় তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সুনামগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম দৈনিক জালালাবাদকে জানান, এবছর সুনামগঞ্জ জেলায় ১৩ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন ধান এবং ৯ লক্ষ ১৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন চাল ঘরে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২ মে পর্যন্ত ১২ লক্ষ ৩ হাজার মেট্রিক টন ধান ও ৮ লক্ষ ২হাজার ৪২২ মেট্রিক টন চাল তোলা হয়ে গেছে। উৎপাদিত ধান থেকে প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টনের বেশী চাল পাওয়া যাবে। যা স্থানীয় চাহিদার ৬ লাখ টন মিটিয়ে আরও ৩ লাখ টনের বেশি চাল উদ্ধৃত্ত থাকবে। এ বছর ফলন ভাল হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। হাওরে উৎপাদিত ধানের মূল্য প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।