উপজেলায়ও ভোটার খরা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ মে ২০২৪, ১০:২৬:৪৬ অপরাহ্ন
ইসির দাবি, ভোট পড়েছে ৩৬ শতাংশ
মোটা দাগে পাঁচ কারণ চিহ্নিত
জালালাবাদ রিপোর্ট : উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথমধাপের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে বুধবার। এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বর্জন করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো। নির্বাচন অনেকটা আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিলো সীমাবদ্ধ। ফলে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটে স্পষ্ট হয়ে উঠে ভোটার খরা।
তবুও ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ বলে জানিয়েছে ইসি। এরমাঝে ইভিএমে ভোটের হার ৩১ দশমিক ৩১ শতাংশ আর ব্যালটে ৩৭ দশমিক ২২ শতাংশ। গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
ভোটার উপস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে আওয়ামী লীগ এবার তাদের কোনো প্রার্থীকে দলীয় প্রতীক দেয়নি। তবে প্রতিটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রচারে উত্তেজনা ও প্রভাব বিস্তারের যে তথ্য ভোটের আগে ছিল, এর প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নাম এসেছে। তবও ভোটের দিন দেখা যায় ভোটার খরা।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) ভোট পড়ার এই হারকে ‘কম’ আখ্যা দিয়ে দায়ী কিছু কারণও চিহ্নিত করেছে।
মো. আলমগীর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মোটা দাগে পাঁচ কারণে ভোট কম পড়েছে। এগুলোর মধ্যে বৈরি আবহাওয়া, ভোটে বিএনপি অংশ না নেওয়া, জনপ্রিয় প্রার্থীর অভাব, ধান কাটার মৌসুম এবং সাধারণ ছুটি থাকায় শ্রমিকরা নিজ এলাকায় চলে যাওয়ায় ভোট কম পড়েছে।
তিনি নির্বাচন ভবনের নিজ দপ্তরে বলেন, ধান কাটার মৌসুম বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে বুরো ধান যেসব এলাকায় আছে, এটা আমাদের আগেই মাঠ প্রশাসন থেকে বলেছে, যে ধান কাটার মৌসুমের জন্য ভোট কম পড়তে পারে। এছাড়া ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। আবার একটি বড় দল রাজনৈতিকভাবে অংশ না নেওয়ায় ভোট কম হয়েছে। শহর এলাকার ছুটি থাকলে শ্রমিকরা বাড়ি চলে যায়। গাজীপুরে কিন্তু ভোট কম পড়েছে। শুধু ধান কাটা না, নানা কারণে ভোট কম পড়েছে। আরও কোনো কারণ থাকলে তা গবেষকরা বলতে পারেন।
সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে সোনাতলা, মীরসরাই ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ১৭ শতাংশ। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায়। সেখানে ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ
জাল ভোট, ব্যালট কেড়ে নিয়ে পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে সিল মারাসহ নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে বুধবার শেষ হয়েছে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপ। প্রভাব বিস্তার নিয়ে কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন সহিংসতা ও ককটেলবাজির ঘটনা ঘটে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিলো চরম হতাশার।
উপজেলা নির্বাচনের ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম চারটি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছিল। সেগুলোতে ভোটারের উপস্থিতিও ছিল বেশি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে। সেবার ভোট পড়ে ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। এবারও বিএনপি, জামায়াত, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ইসলামী আন্দোলনসহ গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো ভোট বর্জন করেছে।
দিন দিন ভোটার কমছে :
২০১৯ সালে প্রথমবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪০ দশমিক ২২ শতাংশ। সেবার পাঁচ ধাপে উপজেলা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত বলে তখন জাতীয় সংসদে বলেন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা।
এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬১ শতাংশের মতো। সে বছর ছয় ধাপে উপজেলা নির্বাচন হয়। দেড় দশক আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি তৃতীয় উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ গত দুই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে কমেছে।
২০১৯ সালে প্রথমবার বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে। এর আগের নির্বাচনগুলোতে দলটির নেতারা অংশ নিয়েছিল। এরপর থেকেই ভোটারের উপস্থিতি কমতে থাকে। এবার দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপির ৭৫ জন অংশ নিয়েছেন। তাঁদের দল থেকে বহিষ্কারও করেছে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের বেশির ভাগেরই উপজেলা ভোটে কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। দু-একটা দলের স্থানীয় নেতারা কিছু কিছু উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভোটের দিন সন্ধ্যায় দলের ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নির্বাচনে ৩০-৪০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি সন্তোষজনক। অনেকের আশঙ্কা ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচন খুনোখুনি-মারামারির মাধ্যমে সমাপ্ত হবে। প্রাণহানি ছাড়া একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একসময় বাংলাদেশের নারীদের দল বেঁধে ভোট দেওয়ার ঘটনা বিশ্বে খবর হতো। এখন আস্থাহীনতার কারণে ভোটার আসে না। কারণ, ভোট দিতে পারবে কি না, দিলে সঠিকভাবে গণনা হবে কি না এবং ফলাফল পাওয়া যাবে কি না, সেই আস্থাহীনতা আছে।
এদিকে, ভোটার নিয়ে খোদ প্রশ্ন চেয়ারম্যান প্রার্থীদেরও। ভোটের দিন বিশ্বনাথের এক প্রার্থী সরকারি কলেজ কেন্দ্র থেকে বের হচ্ছিলেন; তখন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ‘ভোটার কই’। জবাব দিতে গিয়ে তিনিও ক্ষোভ জানালেন। নিজেও বললেন; ‘এত ভোটার গেল কই’। ভোটার না থাকলে নির্বাচন করার যৌক্তিকতা কী?
আরো একাধিক প্রার্থী মনে করেন, ভোট নিয়ে মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। যদিও সিইসি দাবি করেন, ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় ভোটাররা ভোট দিতে যাননি।
প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ভোটের আগেই ৮ চেয়ারম্যানসহ ২৮ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক।