রুদ্ধশ্বাস উৎকন্ঠা শেষে ইরানী প্রেসিডেন্ট-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লাশ উদ্ধার
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ মে ২০২৪, ৭:৪৩:০০ অপরাহ্ন
নতুন প্রেসিডেন্ট মোখবার
জালালাবাদ রিপোর্ট : রাতভর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পর সোমবার সকালে ইরান জানালো, হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। সাথে প্রাণ হারিয়েছেন দেশটির চৌকষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দোল্লাহিয়ানসহ বাকি সফরসঙ্গীরাও।
প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিসহ অন্যদের মরদেহও উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় অনুসন্ধান অভিযানও শেষ হয়েছে। ইরানি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সোমবার এ তথ্য জানিয়েছে।
রেড ক্রিসেন্ট সদস্য ও অন্যদের ধারণ করা বিভিন্ন ভিডিও প্রকাশ করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।তাতে দেখা যায়, স্ট্রেচারে করে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ি অসমতল পথে তাদেরকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল।
ইরানের বিপ্লবী গার্ডস এর ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম তাসনিম জানায়, সবগুলো মরদেহই তাবরিজে নিয়ে যাওয়া হবে। আজ মঙ্গলবার জানাযা ও দাফনের আগ পর্যন্ত সেখানকার ফরেনসিক বিভাগেই থাকবে লাশ। প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং তার সহচরদের গন্তব্যই ছিল তাবরিজ শহর।
প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহতের ঘটনায় ইরানজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তবে জনগণকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি তার কঠোর অবস্থান এবং সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৮৮ সালে কয়েক হাজার মৃত্যুদ- কার্যকরের নেপথ্যে ছিলেন রাইসি। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জন্য ইরানের প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেন তিনি যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে কাজে লাগে। ইসরায়েলের ওপর প্রথমবারের মতো বড় ধরনের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলাও তদারকি করেছিলেন তিনি।
তবে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত রাইসির মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইরান যখন শোক পালন করছে, তখন দেশের অভ্যন্তরসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অনিশ্চয়তার মেঘ ভর করেছে।প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুতে দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তার আকস্মিক অনুপস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও সংঘাতের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করতে পারে।
তবে ইসরায়েলের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর দেশের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা এর সঙ্গে জড়িত নই।’
গত মাসে দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে বিমান হামলায় দুই ইরানি জেনারেল ও পাঁচ কর্মকর্তা নিহত হয়। এর জবাবে রাইসি ও সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইসরায়েলে শত শত ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। এরপর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে।
হেলিকপ্টার বিধ্বস্তে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ায় ঘটনায় শোক জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। শোক জানানো বিশ্বনেতাদের মধ্যে আছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ।
ঘটনার শুরু:
রোববার আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে যান ইব্রাহিম রাইসি। সেখানে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও ছিলেন।অনুষ্ঠান শেষে সেখান থেকে তিনটি হেলিকপ্টারের একটি বহর নিয়ে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজে ফিরছিলেন ইব্রাহিম রাইসি-আব্দোল্লাহিয়ানসহ তাঁদের সঙ্গে থাকা অন্য কর্মকর্তারা।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে গতকাল বলা হয়, ফেরার পথে পূর্ব আজারবাইজানের জোলফা এলাকার কাছে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছায়। ঘটনার পরপরই শুরু হয় ব্যাপক তল্লাশি অভিযান। তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে অভিযান ব্যাহত হওয়ার খবর জানানো হয়।রাইসি ও আব্দোল্লাহিয়ান যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত বেল-২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করছিলেন। তবে বিবিসি জানায়, ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের কাছে এমন কোনো হেলিকপ্টার বিক্রি করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলে এক কর্মকর্তার বরাতে বলা হয়, বিধ্বস্ত হওয়া হেলিকপ্টারটি থেকে অন্তত একজন আরোহী ও একজন ক্রু উদ্ধারকারীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন।
হেলিকপ্টার আরোহীদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ আলী আল-হাশেম। মি. হাশেম তাবরিজের জুমার ইমাম ছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি। ইরানের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’র প্রধান মোহাম্মদ নামি’র মতে আল হাশেম দুর্ঘটনার পরেও পুরো একটি ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন। এমনকি তিনি প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে যোগাযোগেরও চেষ্টা করেছিলেন।
ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ ভাহাদা বলেছেন, চরম বৈরী আবহাওয়ায় প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বহনকারী ওই হেলিকপ্টার দ্রুত অবতরণ করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে।এ পরিস্থিতিতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটবে না।
সোমবার সকালে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলু নিউজ এক এক্স বার্তায় জানায়, ইরানের পাহাড়ি এলাকায় তুরস্কের একটি উদ্ধারকারী ড্রোন তাপের উৎসের সন্ধান পায়। এরপর আরো জোরালো হয় উদ্ধার অভিযান।
উদ্ধারকারীদের ৭৩টি দল তল্লাশিতে অংশ নেয়। সঙ্গে নেওয়া হয় কুকুর ও ড্রোন। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একজন আঞ্চলিক সেনা কমান্ডার বলেন, ওই এলাকায় তীব্র শীত পড়েছে। ঘন কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারপাশ। অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।
ইরানের একজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার পর দেখা যায় বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি পুরোপুরি পুড়ে গেছে। ইরানি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পীর হোসেন কোলিভান্দ বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি খুঁজে পাওয়ার ঘোষণা দেন।
অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার :
হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট বেছে নিয়েছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ গার্ডিয়ান কাউন্সিল সোমবার এ পদে ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারের নাম ঘোষণা করেছে।কাউন্সিলের মুখপাত্র হাদি তাহান নাজিফ এক সাক্ষাৎকারে জানান, সংবিধান মেনে সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদনের ভিত্তিতে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেবেন।
হাদি তাহান নাজিফ আরও বলেন, সর্বোচ্চ ৫০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। এখন সর্বোচ্চ নেতার অনুমতি নিয়ে ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান, পার্লামেন্টের স্পিকার ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে গার্ডিয়ান কাউন্সিল নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করবে।
ইরানের সংবিধানে বলা আছে, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মারা গেলে বা কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে সক্ষম না হলে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরবর্তী ৫০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে এবং নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে হবে। নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।ইরানে প্রেসিডেন্টকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হয় এবং তার ক্ষমতার মেয়াদ চার বছর। একজন প্রেসিডেন্ট পরপর দুবারের বেশি নির্বাচন করতে পারেননা।
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি সরকারের প্রধান এবং সংবিধানের বাস্তবায়ন তার দায়িত্ব। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নীতি এবং পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে প্রেসিডেন্টের হাতে অনেক ক্ষমতা। তবে রাষ্ট্রের যে কোনো ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা শীর্ষ নেতার হাতে।
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাগেরি কানি : পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহতের খবর নিশ্চিতের পর পরই নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন তেহরান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আলি বাগেরি কানিকে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির মন্ত্রিসভায় নির্বাহী, সংসদ ও বিচার, সরকারের ৩ বিভাগের এক বৈঠকের পর ঘোষণাটি আসে।
আলি বাগেরি কানি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন।