ধর্মীয় নেতা থেকে প্রেসিডেন্ট ড. রাইসি
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ মে ২০২৪, ৮:০২:৩৪ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ এক কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা। ২০২১ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেকটা অংশে রক্ষণশীলদের নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করেছিলেন। হাসান রুহানির পর ইরানের রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি।
৬৩ বছরের এই সাবেক বিচার বিভাগীয় প্রধান ব্যাপকভাবে জয়ী হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে। যদিও এই নির্বাচনে প্রভাবশালী মধ্যপন্থী ও সংস্কারপন্থী অনেক প্রার্থীকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং ভোট থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন বেশিরভাগ ভোটারই।
এমন একটা সময় রাষ্ট্রপতির পদে শপথ গ্রহণ করেন রাইসি যখন ইরান তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা, ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনাসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।
রাইসি দায়িত্বভার গ্রহণের পর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইরান যার মধ্যে ২০২২ সালে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, গাজায় ইসরায়েল ও ইরান সমর্থিত ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ। গাজায় চলমান যুদ্ধের সময়েই কিন্তু ইরান এবং ইসরায়েলের ছায়া যুদ্ধ প্রকাশ্যে চলে আসে।অন্যদিকে, ১৯৮০-র দশকে রাজনৈতিক বন্দিদের গণমৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য মানবাধিকার কর্মীদের ক্রমাগত সমালোচনার মুখোমুখি পড়তে হয়েছে ইব্রাহিম রাইসিকে। তার কর্মজীবন বেশ ঘটনাবহুল। বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। খুব অল্প বয়সে সাফল্য পান তিনি। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়েনি তার।
ব্যক্তিগত জীবন : ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম রাইসি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। ইব্রাহিম রাইসির বাবাও ধর্মগুরু ছিলেন।
শিয়া ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী কালো পাগড়ি পরতে দেখা যেত তাকে। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সে কুম শহরে এক শিয়া মাদ্রাসায় যোগ দেন রাইসি।
আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শহীদ মোতাহারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসরকারি আইনে বিশেষীকরণসহ আইনশাস্ত্র এবং আইনের মৌলিক বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন।
সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায়, তিনি পশ্চিমা সমর্থিত শাহ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে আয়াতোল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ-এর শাসনের পতন ঘটে।
ছাত্র অবস্থা থেকেই তাকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যেতে থাকে। পশ্চিমা সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিচার বিভাগে যোগ দেন তিনি। আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছে প্রশিক্ষণের সময় বেশ কয়েকটি শহরে প্রসিকিউটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন খামেনি। রাইসির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তার স্ত্রী জামিলে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং তাদের দুটি সন্তান আছে।
তার শ্বশুর আয়াতোল্লাহ আহমাদ আলামোলহোদা। তিনিও একজন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা এবং মাশহাদ শহরে জুম্মার নামাজ পরিচালনা করেন।বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল রাইসির। বিপ্লবের পর সবগুলো বছরই তিনি বিচারিক পদে কাজ করে এসেছেন। শুধু তাই নয়, যখন জেনারেল প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে তিন বছর আগে আস্তান কুদস রাজাভির দায়িত্ব নেন, সেই সময়েও তিনি বিশেষ করণিক আদালতের কৌঁসুলি ছিলেন।
বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে খুব অল্প বয়সেই সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। ডেপুটি কৌঁসুলি নিযুক্ত হন ইব্রাহিম রাইসি। ১৯৮৮ সালে এক গোপন ট্রাইব্যুনাল বসেছিল, যা ‘ঘাতক কমিটি’ নামেই পরিচিত ছিল। ওই ট্রাইব্যুনালের চারজন বিচারপতির মধ্যে একজন ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। তেহরানের ডেপুটি কৌঁসুলি পদে থাকাকালীনই ওই ট্রাইব্যুনালের অংশ ছিলেন তিনি।রাষ্ট্রীয় পরিদর্শক সংস্থার প্রধান হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন রাইসি। ইরানের বিচার বিভাগের প্রথম উপ-প্রধান পদে নিযুক্ত হন এবং ২০১৪ সালে ইরানের মহাকৌঁসুলি (প্রসিকিউটার জেনারেল) পদের দায়িত্ব পান।
দুই বছর পর আয়াতুল্লাহ খামেনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি দেখাশোনার সব দায়িত্ব তুলে দেন রাইসির হাতে। এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মাশহাদে অষ্টম শিয়া ইমাম রেজার দরগাটির রক্ষণাবেক্ষণ করে।।
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়ে পর্যবেক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন রাইসি। ওই নির্বাচনে অবশ্য তিনি জেতেননি। জিতেছিলেন ধর্মীয় নেতা হাসান রুহানি যিনি প্রথম দফায় ৫৭% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান। নিজেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক যোদ্ধা হিসাবে তুলে ধরা ইব্রাহিম রাইসি ৩৮% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পান ওই নির্বাচনে।
২০১৯ সালে আয়াতুল্লাহ খামেনি তাকে দেশের বিচার বিভাগের ক্ষমতাশালী পদে অধিষ্ঠিত করেন। এরপরের সপ্তাহেই তিনি অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস বা বিশেষজ্ঞম-লির ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দেশটির পরবর্তী সবোর্চ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে ৮৮ ধর্মীয় নেতার সমন্বয়ে গঠিত এই পরিষদ।
২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করার সময় তিনি ‘দেশের নির্বাহী ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে এবং দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অপমান ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্বতন্ত্র মঞ্চে এসেছেন’ বলে দাবি করেন।