সিলেটে কুরবানীর পশু বেড়েছে দ্বিগুণ
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মে ২০২৪, ৮:১৬:১৫ অপরাহ্ন
* ১ বছরে খামারি বেড়েছে ১০ সহস্রাধিক *
* চাহিদা ৩ লাখ ৯৪২৫১ * প্রস্তুত ৪ লাখ ৩০৩৯৭ *
এমজেএইচ জামিল : এক বছরের ব্যবধানে সিলেটে কুরবানীর পশু বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি দামে কিনতে হবে কুরবানীর পশু। এবারও প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে অবৈধ পথে কুরবানীর পশু আসা নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয় খামারিগণ।
আসন্ন ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে সিলেট বিভাগের খামারগুলোতে চলছে কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট করণের কাজ। খামারিরা জানিয়েছেন গো খাদ্যের ঊর্ধ্বগতিতে বেড়েছে ব্যয়। ফলে দাম বেড়েছে পশুর। পাশাপাশি সীমান্ত দিয়ে চোরাই গরু আসা নিয়ে লোকসানের মূখে পড়ায় শঙ্কায় রয়েছেন তারা। অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ বিভাগ বলছে, সিলেটে এবার কুরবানী যোগ্য পশুর কোন ঘাটতি নেই। বরং উদ্বৃত্ত রয়েছে ৩৬ হাজার ১৪৬টি পশু।
অথচ গেল বছর ঈদুল আযহায় সিলেট বিভাগে কুরবানীযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার ৮১৯ টি। আর চাহিদা ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৩টি। গত বছর যেখানে বিভাগে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭৪টি পশুর ঘাটতি ছিল, সেখানে এবছর বিভাগে কুরবানীর পশু ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৪টি বেড়ে উদ্বৃত্ত থাকছে ৩৬ হাজারের বেশী।
প্রাণিসম্পদ ও খামারি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের সময়ের ভয়াবহ বন্যা, নিত্যপণ্য ও পশুখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় গেল বছর খামারিদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় কমেছিল পশুর উৎপাদন। প্রাণিসম্পদের নানা উদ্যোগ, প্রণোদনা ও স্বাবলম্বিকরণ প্রজেক্টের কারণে এবার বিভাগে খামারিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে বেড়েছে উৎপাদিত পশুর সংখ্যা। ১ বছরে বিভাগে ষাড়-বলদ-গাভী ও মহিষের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৬০টি এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৩৫টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসন্ন ঈদুল আযহায় সিলেট বিভাগে কুরবানী যোগ্য পশুর চাহিদা ৩ লাখ ৯৪ হাজার ২৫১ টি। এরমধ্যে সিলেট বিভাগে স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত আছে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৭টি। উদ্বৃত থাকা ৩৬ হাজার ১৪৬ পশু দেশের অন্যান্য জেলায় রপ্তানী করা যাবে।
বিভাগের ৪ জেলার বিভিন্ন খামারে কুরবানীর জন্য প্রস্তুত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ গবাদি পশু। গত কয়েক বছরের মধ্য এবার স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পশু দিয়ে চাহিদা মিটানো সম্ভব। বিভাগে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২২ হাজার ৫৭৬ টি খামারে দিন রাত প্রাকৃতিক উপায়ে চলছে পশু হৃষ্টপুষ্ট করণ কাজ। প্রতিটি খামারে ছোট, মাঝারি ও বড় সবধরণের কুরবানির পশু রয়েছে। এরমধ্যে সিলেট জেলার ৬ হাজার ৮৫৮ টি, সুনামগঞ্জ জেলায় ৩ হাজার ৪৫৮ টি, মৌলভীবাজার জেলায় ৫ হাজার ৩৬৯টি ও হবিগঞ্জ জেলায় ৬ হাজার ৫১৯ টি খামার রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১ বছরের ব্যবধানে সিলেট বিভাগে খামারি বেড়েছে ১০ হাজারের বেশী। গত বছর বিভাগে ১২ হাজার ২১১ জন খামারি থাকলেও এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫৭৬ জনে। এবছর বিভাগে খামারি বেড়েছে ১০ হাজার ২৬৫ জন। ফলে এবার বেড়েছে পশুর সংখ্যা। সকল খামারে চলছে কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট করণ কাজ। প্রতিটি খামারে ছোট, মাঝারি ও বড় সবধরণের কোরবানির পশু রয়েছে।
এদিকে প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, খামারিকে গবাদি পশু হৃষ্টপুষ্ট করণের উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্টেরয়েডের ব্যবহার রোধে উপজেলা পর্যায়ে উঠান-বৈঠক করে খামারিকে হাতে কলমে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
সিলেট বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবছর সিলেট বিভাগে কুরবানী হবে প্রায় ৩ লাখ ৯৪ হাজার ২৫১টি পশু। অথচ প্রস্তুত আছে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৩৯৭ টি পশু। এরমধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার ১৮০ টি ষাড়, ৪৯ হাজার ১০৩ টি বলদ, ৩৩ হাজার ৩৭৫টি গাভী, ৪ হাজার ৫৩৩টি মহিষ, ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৩টি ছাগল, ৭০ হাজার ৯৫৩টি ভেড়া ও ১১০ টি অন্যান্য পশু রয়েছে।
এবছর সিলেট জেলায় কুরবানীর চাহিদা আছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭০৯টি পশুর। এরমধ্যে জেলায় প্রস্তুত আছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৯২১টি পশু। তন্মধ্যে ৬১ হাজার ৫৪০ টি ষাড়, ৩২ হাজার ৪ টি বলদ, ৬ হাজার ১৫১টি গাভী, ২ হাজার ৩৯২ টি মহিষ, ৫৬ হাজার ৯২ টি ছাগল, ২২ হাজার ৭৩৭ টি ভেড়া ও অন্যান্য ৫টি পশু রয়েছে। এবার কুরবানীর চাহিদা পূরণ করে জেলায় ৩০ হাজার ২১২টি পশু উদ্বৃত্ত থাকবে।
সুনামগঞ্জ জেলায় এবার কুরবানী হবে ৫৪ হাজার ৩৬২টি পশু। এরমধ্যে প্রস্তুত আছে ৬২ হাজার ৬৮৮ টি পশু। তন্মধ্যে ২৩ হাজার ৪৫৩টি ষাড়, ৭ হাজার ৫৮৪ টি বলদ, ৭ হাজার ১২৫টি গাভী, ৪৯২ টি মহিষ, ১৩ হাজার ১৫৭ টি ছাগল, ১০ হাজার ৮২৬টি ভেড়া ও ৫১টি অন্যান্য পশু রয়েছে। জেলাটি এবার চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত থাকবে ৮ হাজার ৩২৬টি পশু।
মৌলভীবাজার জেলায় এবছর কুরবানী হবে ৯৮ হাজার ৫৪২ টি পশু। এরমধ্যে জেলায় প্রস্তুত আছে ৮৩ হাজার ৮১২ টি পশু। তন্মধ্যে ২৩ হাজার ২৯৩ টি ষাড়, ৪ হাজার ২৫১ টি বলদ, ৭ হাজার ৫৭ টি গাভী, ৯৯৮ টি মহিষ, ৩২ হাজার ২৮৬ টি ছাগল, ১৫ হাজার ৮৭৫ টি ভেড়া ও ৫২ টি অন্যান্য কুরবানী যোগ্য পশু রয়েছে। বিভাগের একমাত্র এই জেলাটিতে ১৪ হাজার ৭৩০ টি কুরবানী যোগ্য পশুর ঘাটতি রয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলায় এবার কুরবানী হবে ৯০ হাজার ৬৩৮টি পশু। এরমধ্যে জেলায় প্রস্তুত আছে ১ লাখ ২ হাজার ৯৭৬টি পশু। তন্মধ্যে ২৯ হাজার ৮৯৪ টি ষাড়, ৫ হাজার ২৬৪ টি বলদ, ১৩ হাজার ৪২টি গাভী, ৬৫১ টি মহিষ, ৩২ হাজার ৬০৮ টি ছাগল, ২১ হাজার ৫১৫ টি ভেড়া ও ২টি অন্যান্য পশু রয়েছে। জেলাটিতে কুরবানীর চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত থাকবে ১২ হাজার ৩৩৮টি পশু।
সিলেটের একাধিক খামারিদের সাথে আলাপকালে তারা জানান- এমনিতেই সবধরণের পশুখাদ্যের দাম বাড়তি এরমধ্যে তীব্র গরমের কারণে পশুর জন্য বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে আইপিএস দিয়ে ফ্যান চালাতে হচ্ছে। দিনে দুবার গোসল করাতে হচ্ছে। পশুকে ২৪ ঘণ্টা বাতাসের মধ্যে রাখতে হয়। খাবারের সঙ্গে সোডা দিতে হয়। প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করতে হয়। আবার ফসলের মৌসুম হওয়ায় শ্রমিকের মজুরি বেশি দিতে হচ্ছে।’
দেশে প্রচলিত পশুখাদ্যের উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে সয়াবিন খৈল, গমের ভুসি, রাইস পলিশ, মসুর ভুসি, সরিষার খৈল, ভুট্টা, মুগ ভুসি ও মটর ভুসি। এসব উপাদানের দাম এবার ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
অনেক ব্যাপারী শুধু কোরবানির জন্যই কয়েক মাস আগে পশু কিনে ব্যবসা করেন। তাদের মতো একজন শহীন। তিনি বলেন, ‘৬৫ হাজার টাকায় গরু কিনেছি। ২০ হাজার টাকার খাবার খাওয়ানো হয়েছে। এখন যদি ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দাম না পাই তাহলে পোষাবে না।’
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের পরিচালক ডা. মারুফ হাসান দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এবার সিলেট বিভাগে কুরবানী যোগ্য পশুর কোন ঘাটতি নেই। বরং উদ্বৃত্ত আছে ৩৬ হাজার ১৪৬টি পশু। তাই এবার পাশর্^বর্তী জেলা থেকে পশু আসার কোন দরকার নেই। গোখাদ্য ও সব জিনিস পত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের ব্যয় বেড়েছে। সিলেটে আগে ঘরোয়াভাবে কুরবানীযোগ্য পশু পালন হতো। সেটা এখন কমে গেছে। তাই খামারিদের পশু দিয়েই কুরবানীর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরের ন্যায় এবার সিলেট বিভাগে পশুর উৎপাদন বেড়েছে। বিশেষ করে প্রাণিসম্পদ বিভাগের উদ্যোগে বিভাগে ছাগল ও ভেড়ার উৎপাদন বাড়াতে প্রণোদনাসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যার ফলে ১ বছরের ব্যবধানে ছাগল-ভেড়া উৎপাদন বেড়েছে দেড় লাখের বেশী। ৩৬ হাজারের বেশী পশু উদ্বৃত্ত থাকার পরও পাশর্^বর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে পশু আসবে। আবার সিলেট বিভাগ থেকে অন্যান্য জেলা ও বিভাগেও বিক্রি হবে। সিলেটের অনেক প্রবাসীদের বড় গরু কুরবানী দেয়ার আগ্রহ বেশী থাকে। আর এই ধরনের বড় গরু সিলেটে স্থানীয়ভাবে খুব কম উৎপাদন হয়। তাই কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বড় পশু সিলেটে আসে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবেনা। তবে স্থানীয়ভাবেই বেশী পশু কুরবানী হবে।