ভেসে উঠছে রেমালের ক্ষতচিহ্ন : মৃত্যু বেড়ে ২০
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২৪, ১১:০০:০০ অপরাহ্ন
* ৩৯ হরিণের মৃতদেহ, বন্যপ্রাণী নিয়ে শঙ্কা * কাল পরিদর্শনে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী*
জালালাবাদ রিপোর্ট : ঘূর্ণিঝড়ের তা-ব কত প্রলয়ংকারী হতে পারে, আবারো তার সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। সময় যত গড়াচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে প্রবল রিমালের ধ্বংসলীলা। দমকা বাতাস আর ভারী বৃষ্টি কমতে শুরু করার পর দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘুর্ণিঝড়ের তা-বলীলার ক্ষত চিহ্নগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে।
রোববার রাত আটটার দিকে উপকূলে আছড়ে পড়ার পর ব্যাপক তা-ব চালাতে শুরু করে রিমাল। আঘাত হানার পর কিছুটা দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে রূপ নিলেও, প্রায় ৩৬ ঘণ্টা বাংলাদেশের ভূখ-ে অবস্থান করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি চালায়।
পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে বহু রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। ব্যাহত হয়েছে মানুষের জীবিকা ও অর্থনৈতিক জীবন। উপকূলের মানুষের সামনে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন লড়াই; যেভাবে এর আগে ঘুর্ণিঝড়ের তা-বের পর প্রতিবারই ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য সব গল্প তৈরি করেছেন তারা।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিক হিসাব সেরে ফেলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের তা-বে দেড় লাখের বেশি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৩৭ লাখ মানুষ। লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সুন্দরবন। আর কেড়ে নিয়েছে ২০ টি প্রাণ। যদিও সরকারিভাবে জানানো হয়েছে ১০ জনের মৃত্যুর কথা।
জানা গেছে, রেমালের আঘাতে ১০ জেলার মধ্যে ঢাকায় ৪, ভোলায় ৩, বরিশালে ৩, পটুয়াখালীতে ৩, খুলনা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, লালমনিরহাট, বরগুনা, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ধীরগতিতে পার হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থলে উঠে যাওয়ার পরও বহু সময় ধরে দমকা বাতাস ও ভারী বর্ষণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে থাকে। ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
উপকূলের মানুষের মধ্যে এখন হাহাকার চলছে। অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে। দেড় কোটি গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিলো মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত। উপকূলীয় এলাকা মোবাইল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের বাইরে।
প্রবল জোয়ারের তোড়ে বহু জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ উপকূলের বহু এলাকা। পানিতে প্লাবিত গ্রামের পর গ্রাম। জলোচ্ছ্বাসে ১০ থেকে ১২ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায় বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা সেখানে। ভেসে গেছে উপকূলের বহু মাছের ঘের, প্লাবিত হওয়া উপকূলের নি¤œাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে লবণাক্ত পানি। লবণ পানিতে ভরে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীর পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে।
বনের ভেতরে ২৫টি টহল ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লবণপানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে কমপক্ষে ৮০টি মিষ্টিপানির পুকুর।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সারাদেশে ৪৮.৭১ শতাংশ মোবাইল ফোনের সাইট ‘অসচল’ হয়ে গিয়েছিলো বলে জানিয়েছে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি। মূলত বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল টাওয়ারগুলো অচল হয়।
১৫ বছর আগে বাংলাদেশের ভূমিতে ঘূর্ণিঝড় আইলা যে প্রলয় চালিয়েছিলো, রিমালের দীর্ঘসময় ধরে চালানো তা-বেও একই রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা মনে করছেন।
সুন্দরবনে ৩৯ হরিণের মৃতদেহ, বন্যপ্রাণী নিয়ে শঙ্কা :
ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বিধ্বস্ত সুন্দরবনে মিলছে বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ। দুদিনে ৩৯টি হরিণের এবং একটি শুকরের মৃতদেহ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে বনবিভাগ।
রেমালের আঘাত কাটার পর সোমবার প্রথম দুটি হরিণের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে ২৪টি এবং দুপুরের দিকে আর ১৩টি হরিণের মৃতদেহ নদী দিয়ে ভেসে আসে। এ সময় ভেসে আসা আরও ৮টি জীবিত হরিণ উদ্ধার করেছে বনবিভাগ। এভাবে একের পর এক বন্যপ্রাণীর মৃতদেহ ভেসে আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বনবিভাগের খুলনা অঞ্চলের বনসংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দে সাংবাদিকদের বলেন, মঙ্গলবার সকালে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্যের জামতলা এলাকা থেকে ভেসে আসা মৃত ২৪টি হরিণ উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, দুপুরের দিকে সুন্দরবন করমজল কুমির প্রজনন কেন্দ্র এলাকার সামনের পশুর নদী থেকে আরও ১৪টি প্রাণীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ১৩টি হরিণের এবং একটি শুকরের।
“উচ্চ জোয়ারের পানি সুন্দরবনে গহীনে উঠে যাওয়ায় হরিণগুলো ভেসে গিয়ে সাঁতরে কূলে উঠতে না পেরে মারা যেতে পারে বলে ধারণা করছি।”
বনসংরক্ষক বলেন, “ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবের দফায় দফায় উচ্চ জোয়ারে সুন্দরবনের সব নদীখাল উপচে বনের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। এই জোয়ারের উচ্চতা ছিল ১০ ফুটের উপরে। ওই পানি দেখে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীকূলের মৃত্যুর আশঙ্কা করছিলাম। দুইদিনে ২৬টি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এতে বনবিভাগ উদ্বিগ্ন।”
মৃত হরিণগুলো কটকাতে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। আর জীবিত হরিণ বনে অবমুক্ত করা হয়েছে বলে জানায় বনবিভাগ।
দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে কাল যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (৩০ মে) তিনি পটুয়াখালীতে যাবেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।মঙ্গলবার দুপুরে আওয়ামী লীগের সভাপতির ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত বিফ্রিংয়ে এ তথ্য জানান ওবায়দুল কাদের।ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন। প্রথম দিকে তিনি পটুয়াখালী যেতে পারেন। আগামী বৃহস্পতিবার তিনি পটুয়াখালীর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে পারেন।
প্রসঙ্গত, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলে ব্যাপক তা-ব চালিয়েছে। গত রোববার বিকেল নাগাদ ঝড়টির প্রভাব শুরু হয়, আর রাতে ঝড়টির কেন্দ্র উপকূলে আঘাত করা শুরু করে। এরপর গতিপথে রেমাল ঘরবাড়ি-গাছপালা উপড়ে ফেলে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উঁচু জলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে দিয়েছে জনপদ। অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ। ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে কয়েক লাখ মানুষ। মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭ এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪টি।