সিলেটে রেকর্ডব্রেকিং ‘আর্লি ফ্লাড’ নিয়ে প্রশ্ন
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ জুন ২০২৪, ৪:৩২:০৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : এবার আকস্মিক বন্যার কবলে পড়লো সীমান্তঘেঁষা সিলেট। অথচ ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ এর হাওরগুলোতে বন্যার ছিটেফোটাও নেই। তাই এ নিয়ে প্রশ্ন জাগছে, সিলেট জেলায় হঠাৎ বন্যার কারণ কী এবং পানি নামবে কবে?
অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের এবারের হঠাৎ বন্যাকে ‘আর্লি ফ্লাড’ বা আগাম বন্যা এবং রেকর্ডব্রেকিং হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সিলেট জেলায় যে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেটি পুরোপুরি কাটতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে তারা। সংস্থাটি বলছে, গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট জেলার সাত উপজেলায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
সিলেটের এই বন্যা কী অস্বাভাবিক?
সাধারণত মে, জুন ও অগাস্ট মাসে সিলেটে বছরে তিন থেকে চারবার ছোট-বড় বন্যা হয়ে থাকে। কিন্তু মে’র শেষভাবে এরকম বন্যা সিলেটে কখনও হয়নি। পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ দাশ বলেন, ২০২২ সালে এবং এবছরের এই সময়ে যেটা হয়েছে, তা রেকর্ডব্রেকিং। এরকম কখনও হয়নি। এবারের এই আকস্মিক বন্যাকে তিনি ‘আর্লি ফ্লাড’ হিসেবে সঙ্গায়িত করেছেন। তিনি মনে করেন, ২০২২ সালে সিলেটে যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো, এবারের বন্যার ভবাবহতাও সেবারের থেকে বেশি বৈ কম না।
কারণ সুরমা নদীর যে স্থানে আমরা ওয়াটার লেভেল মাপি, তা কানাইঘাট। সেখানে ওয়াটার লেভেল ২০২২ সালে ছিল ১৭ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। এবার সর্বোচ্চ হয়েছে ১৭ দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ, ২০২২ সালের বন্যার চেয়ে ৪২ সেন্টিমিটার উপরে। পানির সমতলের কথা চিন্তা করলে অবশ্যই ২০২২ সালের চেয়ে এবার বেশি পানি এসেছে। ২০২২ সালের জুনের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে যে বন্যা হয়েছিলো, তাতে ওই দুই জেলায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো।
সিলেটে ঘন ঘন বন্যার কারণ :
বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় প্রতিবছর যে বন্যা হয়, তার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরও কয়েকটি কারণ দেখছেন গবেষকরা। নদী গবেষকরা মনে করেন, এআকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদান কাজ করেছে।
তার মাঝে একটি হল নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। ওই অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদীপথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারে না। সেইসাথে, সিলেটসহ হাওর এলাকার অপরিকল্পিত উন্নয়নও এর পেছনে দায়ী।
২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেছিলেন, সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যেরকম ছিল, নদীতে নাব্যতা ছিল, এতো রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি। ফলে বন্যার পানি এখন নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়তো জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেছিলেন, হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে।
এত বৃষ্টির কারণ কী?
পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া অফিস, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয়রা, অন্যান্যবারের মতো এবারও সবাই বলছেন যে এই আকস্মিক বন্যার কারণ অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল। মূলত গত সপ্তাহের সোমবার, অর্থাৎ ২৭ মে থেকে সিলেটে বৃষ্টি শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকে বৃহস্পতিবার, মানে ৩০ মে পর্যন্ত। মে’র শেষ সপ্তাহেই আঘাত হেনেছিলো ঘূর্ণিঝড় রিমাল। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরের মে মাসে শুধুমাত্র সিলেট জেলায় ৭৭৫ মিলিমিটার এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৭০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
সেইসাথে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৯৩ মিলিমিটার এবং তারও আগের ২৪ ঘণ্টায় হয়েছিলো ৬৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে চেরাপুঞ্জিতে। এছাড়া অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমী বায়ু আগে সেট হয়ে গেছে। সাধারণত মৌসুমী বায়ু সেট হতে জুনের প্রথম সপ্তাহ, কখনও কখনও দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত গড়ায়।