৪ ঘন্টার বর্ষণে ভাসলো নগর, আরেকটি নির্ঘুম রাত
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুন ২০২৪, ১১:০০:৩০ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : এমনিতেই ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে প্রবাহিত সুরমা নদী টইটম্বুর। এরমাঝে রোববার রাত ১টা থেকে ফজর পর্র্যন্ত ভারী বৃষ্টি। এতে ডুবল সিলেট নগরের অধিকাংশ এলাকা। আর জলমগ্ন নগরের বাসিন্দারা কাটালেন ২০২২ এ মতো আরেকটি নির্ঘুম ভয়াবহ রাত। তাদের দুর্ভোগ ছিলো কল্পনাতীত।
পানি ঢুকে পড়ে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। ডুবে যায় কয়েকটি প্রধান সড়কও। ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ ঠেকাতে রাত জেগে পাহারা দিতে দেখা যায় নগরবাসীকে। তবুও ঠেকাতে পারেননি পানি। পানির স্রোতের কাছে অসহায় পড়েন নগরের মানুষ। যদিও সকাল গাড়িয়ে দুপুর হলে কিছু এলাকার পানি নেমে যায়।
রাতে বিভিন্ন স্থান ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরের উপশহর, মেন্দিবাগ, মাছিমপুর, তেরোরতন, সাদারপাড়, সোবহানীঘাট, যতরপুর, কুশিঘাট, তালতলা, জামতলা, মণিপুরি রাজবাড়ি, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, পায়রা, দরগামহল্লা, মুন্সীপাড়া, হাওয়াপাড়া, নাইওরপুল, সোনারপাড়া, বালুচর, মীরের ময়দান, কাষ্টঘর, পুলিশ লাইনস, কেওয়াপাড়া, সাগরদিঘিরপার, খাসদবির, কলাপাড়া, মজুমদারপাড়া, লালদিঘিরপার ও মেজরটিলা এলাকা মধ্যরাতের বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকার সড়কও তলিয়ে যায়। বাসা-বাড়িতে কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর সমান পর্যন্ত পানি ছিলো। এ অবস্থায় ঘুমন্ত বাসিন্দারা হঠাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। দিক-বিদিক ছুটোছুটি করেন শত শত মানুষ। অনেককে পানিতে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো কাঁদতে দেখা যায়। শিশু-নারীরা করেন আহাজারী।
এর আগে গত বুধবার এক রাতের ঢলে জলমগ্ন হয়ে গিয়েছিলো সিলেটের ৫ উপজেলা। এবার এই ভয়াবহতার সাক্ষী হলো নগরবাসী। অথচ গত দুদিন বৃষ্টি না হওয়ায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছিলো। ফলে পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিলো সিলেটবাসী। রোববার রাতের ভারী বৃষ্টি সে আশায় হতাশার প্রলেপ মাখিয়ে দিলো।
রোববার সকাল ও বিকেলে কয়েক দফায় বৃষ্টি হয়। তবে রাত থেকে টানা বৃষ্টি হয়। আবহাওয়া অফিস জানায়, সিলেটে ৩৬ ঘন্টায় ২৭৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। আর এমন বৃষ্টি নগরবাসীর মাঝে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ৪২টি ওয়ার্ডের অন্তত শতাধিক এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। কোথাও সুরমা নদীর পানি উপচে প্রবেশ করে, আবার কোথাও ভারী বৃষ্টিতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এমন জলাবদ্ধতা যেন সেই ২০২২ সালের ভয়াবহতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
তবে সিটি করপোরেশন জানায়, ভারী বৃষ্টিতে ও সুরমা উপচে সিলেট নগরের প্রায় ২৮টি ওয়ার্ড প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েন ১০ হাজার পরিবারের লাখো মানুষ। এ অবস্থায় নগরীর প্লাবিত এলাকাগুলোতে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্নের কথাও জানায় নগর কতৃর্পক্ষ।
উপশহরের ডি ব্লকের বাসিন্দা শাহাজান আহমদ বলেন, ঘরের ভেতরে হাঁটু পানি, সড়কে কোমর সমান পানি। না ঘরে থাকতে পারছি, না বাইরে বের হতে পারছি। বছর বছর এই দুর্ভোগ আর ভালো লাগছে না।
উপশহর এলাকার বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম বলেন, তাঁদের এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি। ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি সুরমা নদীর পানিও নালা-নর্দমা দিয়ে চলে এসেছে। তার ঘরেও হাঁটুর ওপরে পানি। বাইরের ময়লা-আবর্জনা ভেসে ঘরে ঢুকেছে। খুবই বিশ্রী ও অসহায় অবস্থায় আছেন। এরই মধ্যে বাসার অনেক জিনিস পানিতে ভাসছে। পানি ক্রমশ বাড়তে থাকায় মানুষ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে ছুটছেন।
যতরপুর এলাকার ফরিদ আহমদ জানান, রাত ৩টার দিকে হঠাৎ তাদের বাসায় ¯্রােতের মতো করে পানি ঢুকতে থাকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই কোমর সমান পর্যন্ত পানি উঠে যায়। ২০২২ সালেও একই অবস্থা ছিলো তাদের বাসায়।
নগরের মির্জাজাঙ্গাল এলাকার বাসিন্দা দেবব্রত চৌধুরী লিটন বলেন, আতঙ্ক উৎকণ্ঠায় আরেকটি নির্ঘুম রাত কাটলাম। রাত ১টার দিকে একবার ঘরে পানি ঢুকে। ঘরের সবাই মিলে সে পানি বের করি।
নগরের অনেক বাসিন্দা জানিয়েছেন, ভারত থেকে আসা ঢলে নগরের কোলঘেঁষা সুরমা নদী ফুলে ফেপে উঠেছে। তাই বৃষ্টির পানি নগরের ছড়াগুলো দিয়ে নদীতে মিশতে পারছে না। এতে নগর জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
ওসমানী মেডিকেলের ৩ ওয়ার্ডে পানি, ক্লাস-পরীক্ষা বাতিল :
টানা বৃষ্টিতে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে পানি জমায় সোমবারের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এছাড়া বৃষ্টিতে হাসপাতালের নিচতলার তিনটি ওয়ার্ডে পানি জমে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন রোগী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালটির প্রবেশ ফটক থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ভবন, কলেজ ফটক, ছাত্রীনিবাস ও ছাত্রাবাসেও পানি উঠেছে। ফলে সেখানে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের পাশাপাশি দুর্ভোগে পড়েন চিকিৎসক, শিক্ষার্থী এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টির তোড়ে হাসপাতালের নিচতলায় প্রশাসনিক ব্লকের ২৬, ২৭ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে পানি ঢুকে যায়। আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকায় প্রশাসনিক ব্লকের কাগজপত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে চাপ বেশি থাকায় মেঝেতে অবস্থান করা রোগীরা কিছুটা ভোগান্তিতে পড়েন। প্রতিষ্ঠানটির পেছনে উত্তর পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত ছড়ার পানি উপচে ক্যাম্পাস ও হাসপাতালে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনেরা বলেন, সোমবার সকাল থেকে হাসপাতালের নিচতলার ওয়ার্ডগুলোতে পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে মেঝেতে আশ্রয় নেওয়া রোগী এবং বাইরের বারান্দার মেঝেতে থাকা রোগীর স্বজনেরা ভোগান্তিতে পড়েন। এ বিষয়ে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের নিচতলায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। হাসপাতালের তিনটি ওয়ার্ডে পানি ঢুকেছে। এতে চিকিৎসাসেবায় ব্যাঘাত ঘটেছে।
এদিকে, নগরের বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হওয়ার পর ফেসবুকে নগরের অনেক বাসিন্দা ক্ষোভ ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দেন। এসব স্ট্যাটাসে তারা অভিযোগ করেন, নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে সিটি করপোরেশনের গত এক দশকে হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু কোনো সুফল মিলছে না। আবার ২০২২ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার পর নগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদী খননের জোর দাবি উঠলেও তা করা হয়নি। যদিও নগর কর্তপক্ষ বলছে, সুরমা উপচে পানি ঢুকলে কিছুই করার নেই।
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, বন্যার কারণে সুরমা নদীর পানিও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নগরের পানি ছড়া-খাল দিয়ে নদীতে গিয়ে মিশতে পারছে না। কোথাও কোথাও বরং নদীর পানি ছড়া দিয়ে নগরে ঢুকেছে। এখন ভারী বৃষ্টিপাতে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। ফলে বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে গেছে। বন্যা পরিস্থিতি ও আশ্রয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মোঃ মখলিছুর রহমান কামরান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইফতেখার আহমদ চৌধুরীসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তরা।