বড়লেখায় পাহাড়-টিলা হাওর ও বনভূমি সুরক্ষায় কর্তৃপক্ষ উদাসীন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০২৪, ৭:৪১:২৮ অপরাহ্ন
আব্দুর রব, বড়লেখা: মৌলভীবাজারের বড়লেখায় প্রাকৃতিক টিলা, পাহাড়, বন ও হাওরের ভূমি সুরক্ষা এবং পুনরুদ্ধারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন উদাসীন। ফলে নানাভাবে প্রাকৃতিক বনভূমি ও জলাভূমি ধ্বংস হচ্ছে। কোথাও পাহাড়, টিলা কেটে সমতল ভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে। যার প্রভাবে অতিউষ্ণ, অতিশীত, অনাবৃষ্টি (খরা), অতিবৃষ্টি, ভূমিধস, ভূমিকম্পসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মানুষজন ও জীবজন্তুকে।
প্রকৃতি সুরক্ষায় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবে থামছে না পাহাড়-টিলা কাটার মতো অবৈধ কর্মযজ্ঞ। অসাধুরা নানা কৌশলে এখানে সাবাড় করছে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের টিলাভূমি। পাশাপাশি ইজারাবিহীন বিভিন্ন ছড়া থেকেও অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে নিষিদ্ধ নেট জাল, কোনা জাল ও বেড় জাল দিয়ে মাছ শিকার এবং বিষটোপে পাখি শিকার চলছে। এতে হাওরের জলজ জীব, অণুজীব মারা যাচ্ছে। প্রাকৃতিক বাস্ততন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র। মারত্মক হুমকিতে মৎস্যসম্পদও।
পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে টিলার মাটি কেটে বিক্রি, বসতবাড়ি নির্মাণ, কৃষি জমি তৈরী, ছড়া থেকে বালু উত্তোলন ও হাওরের পরিবেশ বিধ্বংসী কাজের নেপথ্যে রয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। দীর্ঘদিন থেকে চলা পরিবেশ বিধ্বংসী এসব কাজ বন্ধ করতে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না।
একসময় ছোট-বড় অনেক পাহাড় ও টিলায় সমৃদ্ধ ছিল বড়লেখা উপজেলা। ছিল বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। কিন্তু পাহাড়-টিলা কেটে ফেলায় দিন দিন সমতল ভূমিতে পরিণত হচ্ছে এই উপজেলা। বাড়ছে ভূমিধস, রয়েছে ভূমিকম্পে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা। একাধিকবার টিলা ধসে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। নির্বিচারে প্রাকৃতিক ঝোপঝাড় ও বুনোফলের গাছ, লতা ধ্বংস করায় বিপন্ন হয়ে পড়ছে প্রাণীকুল। টিলা কাটায় বনাঞ্চলে খাদ্য এবং উপযুক্ত আশ্রয়স্থল সংকটে প্রায়ই জনবসতিতে এসে মানুষের হাতে হতাহত হচ্ছে বন্যপ্রাণী।
স্থানীয় সূত্র ও সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর, দক্ষিণ শাহবাজপুর, বোবারথল, বড়লেখা সদর, নিজ বাহাদুরপুর, দক্ষিণভাগ উত্তর ও দক্ষিণভাগ দক্ষিণ ইউনিয়নের জামকান্দি, কাশেমনগর, কেছরীগুলসহ বিভিন্ন গ্রামে টিলা কেটে সমতল করা হচ্ছে। বোবারথল এলাকায় জনসাধারণের যাতায়াত সুবিধার দোহাই দিয়ে রাস্তা সম্প্রসারণের নামে উঁচু উঁচু টিলা কেটে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করা হয়েছে। রাস্তার নামে টিলা কাটার পর এবার এলাকার প্রভাবশালী বাসিন্দারা বসতবাড়ি সমথলে নেওয়ার নামে টিলা কেটে উজাড় করছে। এছাড়া দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের সোয়ারারতল গ্রামের অদূরের দেওছড়া ও কলিরঘাট নামক এলাকায় ১৫-২০টি অবৈধ বালু উত্তোলনের স্পট দেখা গেছে।
হাকালুকি হাওর এলাকার বাসিন্দারা জানান, সেই হাওর-প্রকৃতি এখন আর নেই। যা ৫০ বছর আগেও হাকালুকি হাওরে ছিল। কিন্তু হাওর এখনকার মতো উদাম, বৃক্ষ ও জলজ উদ্ভিদশূন্য ছিল না। ছিল মাছের আকাল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই যুগ আগেও হাকালুকি হাওরে ১১০ প্রজাতির মাছ ছিল। এখন ৫০ প্রজাতির নিচে নেমে গেছে। এ ছাড়া হাওরে মাখনা, পদ্ম, শিঙারা, শাপলা, বনতুলসী, নলখাগড়া, হেলেঞ্চা, বল্লুয়া, চাল্লিয়াসহ শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল। এসব উদ্ভিদ এখন বিলুপ্তপ্রায়। স্থানীয়দের মতে, নামকাওয়াস্তে লোকদেখানো অভিযান চালিয়ে পরিবেশধ্বংসকারী কাজ বন্ধ করা যাবে না। এসব বন্ধে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।
প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, মৌলভীবাজারের পাহাড়, টিলা, বন ও হাওরের ভূমি সুরক্ষা এবং পুনরুদ্ধার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুবই উদাসীন। এখানে নানাভাবে প্রাকৃতিক বনভূমি ও জলাভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে, কোথাও পাহাড়, টিলা কেটে সমতল ভূমির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভূমির গঠনগত শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে। হাওরের বিলগুলো লীজ দেওয়ার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে, অণুজীব মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে হাওরের জীববৈচিত্র। তাই পাহাড়, টিলা, জলাভূমি এবং বনভূমিকে প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে সুরক্ষার ভেতর দিয়ে এই অঞ্চলের ভূমি পুনরুদ্ধারে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ভূমি সুরক্ষায় আদিবাসী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ভেতর বহু লোকায়ত চর্চা ও ব্যবস্থাপনা আছে। সেসব উদাহরণ আমাদের টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় জনগণ, পেশাজীবী সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সর্বস্তরের মানুষকে এই কর্মসূচিতে যুক্ত করতে হবে।
বড়লেখা ইউএনও (চলতি দায়িত্ব) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আসলাম সারোয়ার বলেন, পাহাড় ও টিলা কাটা বন্ধে এবং হাওরের পরিবেশ রক্ষায় উপজেলা প্রশাসনের কঠোর অবস্থান রয়েছে। যারা অবৈধভাবে টিলা ও কৃষি জমির টপসয়েল কাটে, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের দণ্ডিত করা হয়। পাহাড়ি এলাকা বোবারথলসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রাকৃতিক টিলা কেটে পরিবেশ বিনষ্টের খবর পেয়েছেন। সরেজমিনে পরিদর্শন করে সত্যতা পাওয়া গেলে পাহাড়-টিলা ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।