জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব চা চাষে
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ জুন ২০২৪, ৯:৪৬:২২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে চা চাষেও। এই প্রভাব ভবিষ্যতে আরও বেশি করে অনুভূত হতে পারে বলে একাধিক গবেষণায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশে সিলেট, চট্টগ্রাম, উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়সহ কয়েকটি জেলায় চা উৎপাদিত হয়। সবচেয়ে বেশি বাগান আছে বৃহত্তর সিলেটে। দেশের অন্য এলাকাগুলোর তুলনায় সিলেটের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। আবার এখানে বৃষ্টিও বেশি হয়। তবে দেশের উত্তরে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। আবার বৃষ্টি অপেক্ষাকৃত কম হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রায় প্রতিটি স্থানে তাপ ও বৃষ্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ‘বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জলবায়ু: আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের প্রবণতা এবং পরিবর্তন’ শীর্ষক গবেষণায় প্রকৃতির পরিবর্তনের এসব চিত্র উঠে এসেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাসে সিলেট অঞ্চলে আগের চেয়ে তাপপ্রবাহের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সিলেটে শীত বেশি পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে বেশি শীতের দিনের সংখ্যা কমছে। উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের পর প্রাক্-মৌসুমি বায়ুর সময় সিলেটে কমে গেছে বৃষ্টির পরিমাণ।
মো. বজলুর রশীদ বলেন, পুরো দেশেই তাপ ও বৃষ্টির তারতম্য ঘটছে। এর প্রভাব দেশের কৃষিতে পড়েছে ইতিমধ্যেই। চায়ের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশে চা চাষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমআরএইউ) চার গবেষক চায়ের উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। ‘এক্সপ্লোরিং দ্য ইমপ্যাক্ট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অন টি প্রোডাকশন ইন বাংলাদেশ: অ্যানালাইসিং সর্ট অ্যান্ড লং টার্ম অ্যাসিমেট্রিক্যাল ইফেক্ট’ শীর্ষক সেই গবেষণা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এনভায়রনমেন্ট, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সাসটেনেবিলিটি সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
গবেষণায় জলবায়ুগত পরিবর্তনের (গড় বার্ষিক তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমন) সঙ্গে বাংলাদেশের চা উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক লক্ষ্য করা গেছে। এ গবেষণায় ননলিনিয়ার অটো রিগ্রেসিভ ডিস্ট্রিবিউটেড ল্যাগ (এনএআরডিএল) নামের একটি মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে কোনো বিষয়ের সাম্প্রতিক প্রবণতার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য প্রভাব দেখা হয়। বাংলাদেশে ১৯৭৬ থেকে ২০২০ সালে চা উৎপাদনের প্রবণতা দেখা হয়েছে এ গবেষণায়।
এখানে দেখা যায়, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা হঠাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে চা উৎপাদনের ওপর স্বল্পমেয়াদি সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। অর্থাৎ ফলন কমে আসে। গবেষকদের একজন বিএসএমআরএইউর অ্যাগ্রিবিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রুহুল আমিন বলেন, চা উৎপাদনের সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গমনের হার বেড়েছে, এর সঙ্গে উৎপাদন কমে আসছে। এ ছাড়া স্বল্পমেয়াদি চা উৎপাদন প্যাটার্ন লক্ষ করলে দেখা যায়, কোনো বছরে যদি বেশি উৎপাদিত হয়ে থাকে, এর পরবর্তী বছরগুলোতে নিম্ন উৎপাদন প্রবণতা লক্ষণীয়। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের সঙ্গে গড় তাপমাত্রার একটি মাঝামাঝি পর্যায়ের সম্পর্ক আছে। এর পরিমাণ ধরা যায় ৩৫ শতাংশের বেশি। তাপমাত্রা বাড়লে চায়ের উৎপাদন সামান্যই বাড়বে।
চায়ের দেশ সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক অনিমেষ সরকার চায়ের গুণগত মান নিয়ে গবেষণা করছেন। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পরিবর্তনের বিষয়টি চায়ের ওপর ইতিমধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন অধ্যাপক অনিমেষ। তিনি বলেন, চা চাষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ১৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর বেশি বা কম হলে চায়ের উৎপাদন কমতে থাকে। বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এপ্রিল, মে মাসে বা অন্য সময়েও বিদ্যমান। সহনীয় তাপমাত্রার চেয়ে ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশি থাকলে চায়ের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং তাপমাত্রার প্রভাব বাংলাদেশের চা উৎপাদন অনেকাংশে কমেছে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের ধরনের পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের চা উৎপাদনে এগিয়ে থাকা চীন, ভারত, কেনিয়াসহ নানা দেশে চায়ের উৎপাদন কমেছে বলে জানান এই গবেষক। চায়ে থাকা থিয়েফ্লেভিনস ও থিয়ারুবিজিন নামের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের পরিমাণের ওপর ব্ল্যাক চায়ের রং, উজ্জ্বলতা, লিকার উৎপাদনক্ষমতা নির্ভর করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে চায়ের উৎপাদন যেমন কমতে থাকে, তেমনিভাবে চায়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের পরিমাণও কমতে থাকে। এর ফলে চায়ের গুণগত মানও কমে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
চা চাষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে অনুভূত হচ্ছে। ‘অবজারভিং ক্লাইমেট ইমপ্যাক্টস অন টি ইলড ইন আসাম, ইন্ডিয়া’ শীর্ষক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে চায়ের উৎপাদন ৪ শতাংশ কমে যায়।
শ্রীলঙ্কার চা উৎপাদন নিয়ে ‘দ্য ইমপ্যাক্ট অব চেঞ্জিং ক্লাইমেট অন পেরিনিয়াল ক্রপস: দ্য কেস অব টি প্রোডাকশন ইন শ্রীলঙ্কা’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ বেড়ে গেলে চায়ের উৎপাদন কমে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।চায়ের উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের এসব সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ভাবছে সরকারের চা-সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোও।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, বেশি তাপ এবং বৃষ্টির হেরফের দেখা যাচ্ছে। তাপপ্রবাহ থেকে চায়ের সুরক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এর মধ্যে আছে বাগানে যথাযথভাবে ছায়াবৃক্ষ লাগানো, প্রুনিং ঠিকমতো করা, সঠিক সময়ে চায়ের গাছ লাগানো, বয়স্ক পাতা ফেলে দেওয়া এবং কর্মক্ষম পাতা বেশি রাখা।