আলোচনায় নগররক্ষা বাঁধ : কেন ডুবে নগর?
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০২৪, ৮:২২:২৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট:
মাত্র ৪ ঘন্টার অতিবৃষ্টি। এতেই তলিয়ে গেল সিলেট নগরের ২৮টি ওয়ার্ড। যেদিকে চোখ যায় থৈ থৈ পানি। ঠিক একইভাবে ২০২২ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল সিলেট নগর। এ অবস্থায় এখন প্রশ্নের পাহাড় জমেছে মানুষের মনে। এত উন্নয়নের পরও কেন বার বার ডুবে সিলেট নগর?
আবারো নগর ডুবে যাওয়ায় আলোচনায় নানা বিষয় সামনে আসছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে নগররক্ষা বাঁধ, ছড়া খনন ও সুরমা খনন বিষয়ে। এই তিনটির সমন্বিত উন্নয়ন হলে সিলেট নগর বেঁচে যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
২০২২ এর পরও আলোচনা উঠেছিলো সিলেট নগররক্ষা বাঁধ নিয়ে। এবারও একই আলোচনা। নগরের বিভিন্ন প্লাবিত এলাকা পরিদর্শনকালে নগররক্ষা বাঁধের গুরুত্ব তুলে ধরেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। নগরকে বাঁচাতে তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ প্রকল্প নেয়ার কথাও বলেন। একই দাবী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমানেরও। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে সুরমা নদী খনন ও নগররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা জরুরি। এ নিয়ে সিটি করপোরেশন কাজ করছে।
তবে সিলেট নগররক্ষা বাঁধ নিয়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন সাবেক মেয়র আরিফ। গত ১ জুন সিলেটের একটি অনুষ্ঠানে একই কথা বলেছিলেন সিলেট ১ আসনের সংসদ সদস্য ড. এ.কে. আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নগররক্ষা বাঁধ আর নদী খননের কাজে ধীরগতি হওয়ায় বন্যায় ভোগান্তিতে পড়েছেন সিলেট নগরের বাসিন্দারা। প্রসঙ্গত, জাতীয় নির্বাচনের আগে ড. মোমেন অঙ্গীকার করেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে সিলেটে নগররক্ষা বাঁধ হবে। ২০২২ এর ভয়াবহ বন্যার পর ‘নগররক্ষা বাঁধ’ নির্মাণের দাবি ওঠে। সেসময় জুনে প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফরকালে তৎকালীন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নগররক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দেন। কিন্তু এখনো সেই আশ্বাসের দৃশ্যমান কিছু ঘটেনি।
সুরমা নদীর তীরবর্তী নগরের মাছিমপুর, উপশহর, ছড়ারপার, কালীঘাট, কিনব্রিজ, তোপখানা কাজিরবাজার, শেখঘাট, ঘাসিটুলা, মজুমদারপাড়া ও কানিশাইল এলাকা ঘুরে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের সঙ্গেই কথা হয়। তারা জানান, বর্ষা মৌসুমে যখন সুরমা নদী পানিতে টইটম্বুর থাকে, তখন প্রায়ই ভারী বৃষ্টিপাতে নদীর তীরবর্তী আশপাশের এলাকা তলিয়ে যায়। তবে ২০২২ এর মাত্রাতিরিক্ত পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে নদীর পানি উপচে পুরো শহরই তলিয়ে যায়। দুই বছরের মাথায় আবারও এর পুনরাবৃত্তি ঘটলো। কিন্তু কী পদক্ষেপ নেয়া হলো? সাবেক মেয়রের মতো এসব এলাকার মানুষও টেকসই শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও দ্রুত নদী খননের দাবি তুলছেন সরকারের কাছে। এছাড়া অনেকের অভিযোগ, নদী ও ছড়া পরিকল্পিতভাবে আরও সুগভীর করার পাশাপাশি অবৈধ দখলমুক্ত করে খনন করা হতো, তাহলে নগরের বন্যা পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ রূপ নিত না। নগর দিয়ে প্রবাহিত ছড়া ও খালগুলো যথাযথ খননের অভাবে পানির ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত এক দশকে ছড়া খনন, ছড়ার পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ, ইউটাইপ ড্রেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নালানর্দমা প্রশস্তকরণসহ জলাবদ্ধতা নিরসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে গত এক দশকে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকার কাজ করেছে সিটি করপোরেশন। এর বাইরে চলতি বছর তিনটি ড্রেন নির্মাণে খরচ হয় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি আরও ৫৫ কোটি টাকার কাজ চলছে। সম্প্রতি ৩০০ কোটি টাকার কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন হয়। এ ছাড়া পাউবো সুরমা নদীর নগর অংশ খননে খরচ করছে ৫০ কোটি টাকা বলে শোনা যায়। তবুও কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতে ডুবে যাচ্ছে সিলেট নগর। এ নিয়ে মানুষের মাঝে জমেছে ক্ষোভ আর হতাশা।
সচেতন মহলের অভিযোগ, জলাবদ্ধতা দূর করতে সিটি কর্তৃপক্ষ ও পাউবো বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এতে কাঙ্খিত সুফল পাওয়ার বদলে জলবদ্ধতার সংকট আরও বাড়লো। তাহলে এত টাকা খরচ করে নগরবাসীর কী লাভ হলো।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে নিশ্চয়ই ঘাপলা আছে। না হলে এত টাকা খরচের পরও কেন শহর ডুববে? অতীতেও সিলেটে প্রচুর বৃষ্টি হতো, তবে এমনভাবে শহর কখনোই ডুবেনি। তবে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, প্রকল্প ঠিকভাবে হয়েছে বলেই এখন আগের তুলনায় জলাবদ্ধতা কমেছে। এখন চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে সুরমা নদী পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকায় নগর দিয়ে প্রবাহিত ছড়া ও খালের পানি নামতে পারছে না, বরং উল্টো নদীর পানি নগরে ঢুকছে। পাউবো বলছে, ২০২২ সালের বন্যার পর সুরমা নদী খননের দাবি ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নগরের কুশিঘাট থেকে লামাকাজি সেতু পর্যন্ত যেসব স্থানে চর জেগেছে, তা কেটে অপসারণ ও খনন কাজ অব্যাহত আছে। চলতি জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাদের আশঙ্কা, নদী খনন নিয়ে কোনো নজরদারি না থাকায় প্রকল্পের ৫০ কোটি টাকা জলে যেতে পারে। এদিকে, রোববার রাতের বৃষ্টিতে প্লাবিত অনেক এলাকা এখনো জলমগ্ন। কিছু এলাকার পানি নামলেও নদীতীরবর্তী ও নিচু এলাকার পানি নামছেনা। অল্প নামলেও তাতে ধীরগতি। মাছিমপুর, উপশহর, তেরোরতন, কুশিঘাট, ছড়ারপাড়সহ অনেক এলাকা থেকে পানি নামেনি। এতে এসব এলাকার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। এরমাঝে মঙ্গলবার সকালেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। শেষ ২৪ ঘন্টায় সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে ১১২ মিলিমিটার। এতে এসব এলাকার মানুষের মাঝে নতুন আতংক বিরাজ করছে। স্থানীয় অনেকেই জানিয়েছেন, পানি না নামায় তাদের এলাকা ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোন পথ নেই। সিটি করপোরেশন ও পাউবো বলছে, সুরমার পানি ১০.৭২ সেন্টিমিটার নিচে নেমে এসেছে। আগামী ২/৩ দিন বৃষ্টি না হলে পানি পুরোপুরি নেমে যাবে। এদিকে, সিলেট নগর ডুবে যাওয়ার প্রেক্ষিতে সফর সংক্ষিপ্ত করে কাল বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্য থেকে ফিরছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি এলে শহর রক্ষা বাঁধের আলোচনা গতি পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।