সংকটের সময়ে ঘাটতির বাজেট
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ জুন ২০২৪, ১০:৫০:১৪ অপরাহ্ন
৮ লাখ কোটির বাজেট পেশ অর্থমন্ত্রীর
এ বাজেটেও ঋণ নির্ভরতা
জালালাবাদ রিপোর্ট : রিজার্ভসংকট, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির নানা সংকটের এ সময়ে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ নিয়ে ঘোষিত এ বাজেট দেশের সবচেয়ে বড় বাজেট।
বাজেটে রাজস্ব আয়সহ মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা; বাকি ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে।
বিশাল অংকের এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির চার দশমিক ছয় শতাংশ। বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল হিসেবে ব্যাংক খাত বেছে নিয়েছে সরকার। নানামুখী অর্থনৈতিক চাপের মধ্যেও ১৭ শতাংশের বেশি জোগাড় করতে হবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে।
ঘাটতি পূরণে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এই অংক চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাঁচ হাজার ১০৫ কোটি টাকার বেশি। গত অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। তবে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় এটি বাড়িয়ে এক লাখ ৫৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা ঠিক করা হয়েছে।
তবে বাজেট উপস্থাপন হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন অর্থমন্ত্রী। যে সময়ে অর্থনীতি নানান সংকট মোকাবিলা করছে; বিশেষ করে ডলার-সংকট, আমদানিতে কড়াকড়ি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্সে খরা ইত্যাদি সার্বিক অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিচ্ছে। সরকারকে সামনে বিনিয়োগ বাড়ানো, জিনিসপত্রের দাম কমানোর মতো কঠিন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
সবার প্রথমে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন অর্থমন্ত্রী তা হল মূল্যস্ফীতি। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামবিহীন মূল্যতে নাকাল দেশবাসী। খাদ্যের মূল্যস্ফীতি এখন ১০ শতাংশের বেশি। শুধু খাদ্য কিনতে গিয়েই বেশির ভাগ মানুষ তাঁদের আয়ের বড় অংশ খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বছরজুড়েই মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হয়েছে সীমিত আয়ের মানুষ।
যদিও এবারের বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমালোর লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে তবে দেখা বিষয় কতটুকু কার্যকর হয় এসব পদক্ষেপ। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপগুলো এখন পর্যন্ত কেবল ফাঁকা আওয়াজই করেছে।
অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলীর জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ বৃদ্ধি। প্রতিনিয়তই কমছে রিজার্ভ। আমদানি এখনো নিয়ন্ত্রিত খাত। মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। দায় পরিশোধে বাংলাদেশের সামর্থ্যের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা কেবলই কমছে। বৈশ্বিক বড় রেটিং এজেন্সিগুলো বাংলাদেশের রেটিং অবনমন করেছে।
প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারের হাতে অর্থপ্রবাহ কমছে। ঘাটতি মেটাতে নির্ভর করতে হচ্ছে দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর।
কোন খাত সর্বোচ্চ বরাদ্দ :
সরকার যে বাজেট উত্থাপন করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি খরচ হবে ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে। প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা বাজেটের ১৪.২ শতাংশ খরচ হবে ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে, যার পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে। মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এই খাতে খরচ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মোট পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ব্যয় করা হবে মোট বাজেটের ১১.১ শতাংশ, যার পরিমাণ ৮৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এছাড়া পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ব্যয় করা হবে ১০.২ শতাংশ, যার পরিমাণ ৮১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এদিকে, বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য বাজারের সরবরাহ শৃঙ্খলে ত্রুটি ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
লিখিত বক্তৃতায় তিনি বলেন, দেশের বাজারে সরবরাহ শৃঙ্খলে ত্রুটি বাংলাদেশে এ উচ্চ মূল্যস্ফীতির একটি প্রধান কারণ। তবে আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার অবচিতি (মান কমে যাওয়া)। ২০২১-২২ অর্থবছরে করোনা অতিমারির প্রকোপ কমে এলে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ওই বছরে বাণিজ্যঘাটতি ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের ওপর চাপ তৈরি হয়।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই মাসের শেষে ছিল ৩৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যা চলতি বছরের মে মাসের শেষে কমে হয়েছে ২৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই হতে এ পর্যন্ত রিজার্ভ হতে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়তে হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই থেকে চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ মান কমেছে, যার ফলে আমদানি করা পণ্যের মূল্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এভাবে আমদানিজনিত মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির ওপর।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ শুরু হয়। প্রায় দুই ঘণ্টাবাপী বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী নানা দিক তুলে ধরেন।
এটি দেশের ৫৩তম ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৫তম বাজেট। জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী।
এর আগে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের আগে দুপুর ২টার দিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা অনুমোদন করা হয়। ওই প্রস্তাবে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরে সংসদে পাস হয়ে ১ জুলাই থেকে নতুন অর্থবছর শুরু হবে।