সিলেটে সুরমায় উন্নতি, কুশিয়ারা অঞ্চলে অবনতি
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ জুন ২০২৪, ৪:০০:৪২ অপরাহ্ন
ঢলের তোড়ে তছনছ সীমান্তবর্তী এলাকা
স্টাফ রিপোর্টার : সিলেটে সুরমা নদী ঘেঁষা অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। সুরমানদীসহ সব কটি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচে অবস্থান করছে। বন্যা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হলেও এখনো প্লাবিত জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৮ শতাধিক গ্রাম। তবে জেলার কুশিয়ারা নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে অবস্থান করছে। তাই কুশিয়ারা অঞ্চল বালাগঞ্জ, জগন্নাথপুর, আজমিরিগিঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা নতুন করে প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে অধিকাংশ লোকজন নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরে গেছেন। গতকালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জেলার ৫৫১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪৪০ জন অবস্থান করছেন। ৪ জুন পর্যন্ত এসব আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে ৬ হাজারেরও বেশি মানুষ অবস্থান করছিলেন।
পানি নেমে গেলেও সিলেটে ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। তছনছ করে দিয়ে গেছে উজানের তীব্র ঢল। সীমান্তবর্তী ৫ উপজেলার বেশির ভাগ সড়কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছোট-বড় গর্তে পরিণত হয়েছে গ্রামীণ সড়ক। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে এসব ক্ষতচিহ্ন এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এখনো পানি বিদ্যমান থাকায় অনেক স্থানে ক্ষতি নিরূপণ করা যায়নি। তবে টাকার অঙ্কে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপণ করতে আরো কিছু দিন সময় লাগবে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ভারতের ঢলের তোড়ে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।কানাইঘাট ও জৈন্তাপুরে স্রোত এতটাই বেশি ছিল রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ সবই পানির তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে বহু এলাকার সঙ্গে এখনো সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়নি।
এদিকে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায় , হাওর ও জলাশয় পরিপূর্ণ থাকায় নদ-নদীর পানি ধীরগতিতে কমছে। তবে পানি কমার বিষয়টিই ভালো খবর। নতুন করে পানি বৃদ্ধি না পাওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।সিলেট আবহাওয়া অফিস বলেছে, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত শেষ ২৪ ঘন্টায় সিলেটে কোনো বৃষ্টি হয়নি। তবে সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, সিলেটে আজ রোববার মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করছে। এছাড়া পানি ২৬ সেন্টিমিটার কমেছে।সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পানি বিপদসীমার ৮১ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করছে, আগেরদিনের তুলনায় শনিবার পানি ১৯ সেন্টিমিটার কমেছে।তবে কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপরে অবস্থান করছে। নদীর ওই পয়েন্টে বিপদসীমা ৯ দশমিক ৪৫ সেন্টিমিটার। শনিবার সন্ধ্যায় ওই পয়েন্টে পানি ৯ দশমিক ৯৪ সেন্টিমিটারে অবস্থান করছিল। এছাড়া সিলেটের ধলাই, লোভা, গোয়াইন, সারি নদ-নদীর পানিও কমছে বলে জানিয়েছে পাউবো।
তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, কোনো কোনো এলাকায় পানি নেমে যাওয়ায় ভাঙা সড়কগুলো ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে।গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জসহ বন্যাদূর্গত বিভিন্ন এলাকার স্থানীয়রা জানান, বন্যা কবলিত অনেক গ্রামের মাটির ঘর ভেঙে গেছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে, তলিয়ে গেছে ফসল। গ্রামের প্রায় সব রাস্তাই ভাঙা। রান্নাঘর পানির নিচে থাকায় অনেকেই রান্না করতে পারছেন না।
এদিকে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার জলাবদ্ধতা কমেছে। খাল-বিলের পানি নেমে গেছে। তবে পানি কমলেও প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এজন্য পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
বালাগঞ্জে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা :
বালাগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিলেটের বালাগঞ্জে প্রতিনিয়ত বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বিগত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টি পাহাড়ি ঢল ও উজান থেকে নেমে আসায় কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ায় উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। কয়েকদিনের বন্যায় নতুন করে প্লাবিত হয়েছে প্রায় ২০টি গ্রাম ।
এছাড়াও উপজেলার ৬ টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে কৃষি জমি, মৎস্য খামার প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে। উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে উপজেলার ২ টি বিল নার্সারিসহ ২০০ টি পুকুর প্লাবিত হয়ে, ১৪ মেট্রিক টন মাছ, ৫ লক্ষ ২০ হাজার পোনা মাছ নষ্ট হয়ে গেছে, মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬২ লক্ষ টাকা। পানি বাড়তে থাকলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। উপজেলা কৃষি অফিসের সুত্রে জানা যায়,উপজেলায় ইতোমধ্যে রোপনকৃত ৪৮ হেক্টর জমি পানির নিচে চলে গেছে,৫১ হেক্টর আউস ধানের বীজ তলা পানির নিচে তলিয়ে গেছে এবং ২৬৫ হেক্টর সবজি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মারিয়া হক জানান, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৬টি ইউনিয়নের মানুষের জন্য ১৫ টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে ২৫ মেট্রিক টন শুকনো খাবার মজুদ করা হয়েছে , ২ লক্ষ ৬০ হাজার নগদ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও দুর্গত মানুষের খোঁজ নিতে ইউনিয়নগুলোতে পরিদর্শন করেছেন। সেচ্ছাসেবক,মেডিকেল টিম,উদ্দারকারী নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল-রুম খোলা হয়েছে। বন্যা-কবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে । দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে। বন্যা প্লাবিত এলাকার জন সাধারণদের আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন উপজেলার কর্মকর্তারা।
বৃষ্টিপাত ছাড়াই উজানের পানিতে সুনামগঞ্জের ৫০ গ্রাম প্লাবিত :
সুনামগঞ্জে গত দুই দিন ধরে বৃষ্টিপাত কম হলেও উজানের পানিতে বাড়ছে সুনামগঞ্জের নদ-নদী ও হাওরের পানি। নতুন করে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর, শান্তিগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার অন্তত ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জগন্নাথপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
জগন্নাথপুর-বেগমপুর সড়কে পানি ওঠায় লাউতলা-রসুলগঞ্জ সড়কসহ বেশ কয়েকটি গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে গেছে। পাইলগাঁও, রাণীগঞ্জ, আশারকান্দি, চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়নের অন্তত ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বড় ধরনের বন্যার সতর্কতা নেই। ভারতের মেঘালয়ে খুব একটা বৃষ্টিপাতের খবর শোনা যায়নি। তবে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে পানি কেন বাড়ছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে পানি নেমে যাবে।
আজমিরীগঞ্জের তীব্র হচ্ছে কুশিয়ারার ভাঙন :
ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলা কুশিয়ারা নদীর পাড়ের মানুষ। বর্ষার আগেই পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টির কারণে হু হু করে পানি বাড়ছে নদীতে। এমন পরিস্থিতিতে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, দিনের পর দিন এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা। কয়েক বছর ধরে চলা নদীর ভাঙনে এরইমধ্যে বিলীন হয়েছে তাদের অনেকেরই সহায় সম্বল। বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন বহু বাসিন্দা। অল্প বিস্তর যা অবশিষ্ট আছে, তা হারানোর ভয়ে আছেন অনেকেই। তাদের অভিযোগ, ভাঙন ঠেকাতে টেকসই পদক্ষেপ না নেওয়ায় এই ভোগান্তি কমছে না। যেসব কাজ করা হয় সেখানেও থাকে অনিয়ম। যা মানুষের দুর্ভোগ বাড়ায়। ভাঙন শুরু হলেই কিছু জিও ব্যাগ ফেলে নিজের দায়িত্ব সারেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার সরেজমিনে কুশিয়ারা পাড়ে দেখা যায়, কালনী-কুশিয়ারা নদীর ভাঙন প্রতিদিন বাড়ছে। কাকাইলছেও ইউনিয়নের মনিপুর, সৌলরী, কালনীপাড়ার কয়েকটি বসতঘর যে কোনো সময় নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়ে বিপাকে পড়েছেন অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষ। ভাঙনকবলিত অনেকে আত্মীয়-স্বজন ও সরকারি পতিত জমিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়াও বদরপুরসহ আশপাশের আরো কয়েকটি গ্রামের লোকজন ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।