টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বাস : ঝরছে প্রাণ, দায় কার?
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২৪, ৪:০০:০৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই প্রতি বছর সিলেটে পাহাড় ও টিলা ধসের উদ্বেগ-আতঙ্ক তৈরী হয়। এই উদ্বেগ-আতঙ্কের মাঝে কখনো কখনো টিলা ধসের ঘটনা ঘটে, প্রাণহানিও হয়। এরপর সর্বত্র আলোচনা হয়, প্রশাসনের তোড়জোড়ও শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিন গেলেই এই তোড়জোড় সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায়। আর তাই টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়েই বাস করে হাজারো পরিবার।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন জানিয়েছে, সিলেট নগর ও জেলায় গত এক দশকে টিলাধসে ৪০ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালে জৈন্তাপুরে এক পরিবারের ৪ জন মারা যান।
সর্বশেষ গত সোমবার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন নগরের চামেলিবাগের আগা করিম উদ্দিন (৩৪)। কিন্তু সে ঘুম আর ভাঙল না। ঘুমের মধ্যেই টিলার মাটি ঘরের ওপর ধসে পড়ে স্ত্রী-সন্তানসহ তিনজনই মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান। এরপরই নতুন করে আলোচনায় এলো টিলার পাদদেশে বসবাসের ঝুঁকি। প্রশ্ন সামনে এসেছে, টিলার পাদদেশে বার বার এসব অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর দায় আসলে কার?
এ ঘটনার পর মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলছেন, টিলার পাদদেশ থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বাসিন্দাদের। তিনি জিরো টলারেন্স নীতিরও ঘোষণা দিয়েছেন। এতে প্রশ্ন উঠছে, মেয়র তো নগরের ভেতরের বাসিন্দাদের ব্যাপারে নির্দেশনা দিলেন। কিন্ত বৃহত্তর সিলেটে এমন হাজারো টিলায় হাজার হাজার মানুষ বাস করছেন। তাদের নিরাপত্তা দেখবে কে?
সিলেট নগরী ও সদর উপজেলাসহ জেলার গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় সহস্রাধিক পাহাড়-টিলা রয়েছে। তবে এ সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান নেই জেলা প্রশাসনের কাছে। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিভিন্ন সময় সিলেটের পাহাড়-টিলা নিয়ে জরিপ করেছে। বেলার তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগে ১ হাজার ৭৪৫টি (২৭৪৯.৫০ একর) টিলাভূমি রয়েছে। এর মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশন, সিলেট সদর উপজেলা, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে ১ হাজার ২৫টি টিলাভূমি রয়েছে। এ ছাড়া ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও ও সদর ইউনিয়নে ২৫১.০৮ একর টিলাভূমি রয়েছে।
সংস্থাটির তথ্য মতে, নগরের ব্রাহ্মণশাসন, দুসকি, হাওলাদারপাড়া, মেজরটিলা, খাদিমনগর, মালনীছড়া, বালুচর, চন্দনটিলাসহ অন্তত ৩০টি স্থানে টিলার পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে অন্তত ১০ হাজার পরিবার বসবাস করছে। এর বাইরে বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়ও টিলার ঢালু ও পাদদেশে অসংখ্য বসতি আছে। সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ২০১৭ সালের জরিপেও দেখা গেছে, নগরে টিলার পাদদেশে বাড়ি তৈরি করে বাস করছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। তবে এ সংখ্যা বর্তমানে দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলে তাদের ধারণা।
টিলার উপরে ও পাদদেশে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকজনই এরকম দরিদ্র। স্থানীয় প্রভাবশালীরা টিলা কাটা ও দখলের জন্য দরিদ্রশ্রেণির লোকজনদের বসিয়েছেন। আবার কম টাকায় পেয়ে টিলার পাদদেশে জমি কিনেও ঘর বানিয়েছেন অনেকে।
যদিও ২০১২ সালে সিলেটের পাহাড় টিলা সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের এক রায়ে টিলার উপর ও পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করা দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে পুণবার্সনের নির্দেশনা দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালে আমাদের করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত সিলেটে পাহাড় টিলা কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে পাহাড় টিলা সংরক্ষণ ও তার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষজনকে পুণর্বাসনের নির্দেশনা দেন। কিন্তু ওই রায়ের ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
তবে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, গত ২৮ মে থেকে সিলেটে টানা ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার পর টিলার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস না করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন মাইকিংয়ের পাশাপাশি সতর্কতামূলক প্রচারণা চালিয়েছে। এটা অব্যাহত আছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ টিলার পাদদেশে লাল নিশানও টাঙানো হচ্ছে।
এদিকে, অনেকে বলছেন, রাতের আঁধারে সিলেটের পাহাড়টিলা কেটে বসতি আর মাটি বাণিজ্যের খেসারত ‘চামেলীবাগ ট্রাজেডি’! ঝুঁকি নিয়ে টিলায় বসবাসের পাশাপাশি বড় আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে বেপরোয়া টিলা কাটা। প্রভাব খাটিয়ে নানা কারণে নানাভাবে কাটা হচ্ছে টিলা। অথচ প্রশাসন নির্বিকার। সরেজমিন ঘুরে নগরের আশপাশে অসংখ্য টিলা কাটার চিত্র চোখে পড়েছে।
মাসখানেক ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে সিলেটে। বৃষ্টির সময় মাটিধস নামাতে টিলায় টিলায় সরু নালা কেটে রাখা হয়। টানা বৃষ্টিতে নরম হয়ে আসা মাটি সেই নালা বেয়ে নেমে আসে টিলার পাদদেশে। আবার অনেক স্থানে কেটে রাখা হয় টিলা। কেটে রাখা তেমনি একটি টিলায় ধস নামে সোমবার।
বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, সিলেটের পাহাড়-টিলা রক্ষায় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। দায়িত্বশীলদের অনেকেই পাহাড়-টিলা রক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করেন না। তাই কোনোভাবেই টিলা কাটা ও টিলার পাদদেশে বাস থামানো যাচ্ছে না।
এদিকে, চামেলীভাগে নিহত ৩ জনের পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না দিতে গিয়ে মঙ্গলবার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও বলেছেন, সিলেটে অবৈধভাবে টিলা কাটা হয় প্রচুর। এগুলো রোধ করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ কমিটি করে টিলা কাটা ঠেকাতে হবে। অভিযোগ রয়েছে- স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব কাজে জড়িত থাকেন। তাই তাদের মাধ্যমেই টিলার মাটি কাটা রোধ করা প্রয়োজন।