বন্যা অগ্নিকান্ডের চেয়েও ভয়াবহ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ জুন ২০২৪, ১২:৩৫:৫৩ অপরাহ্ন
কথায় আছে আগুন সোনাদানা ছাড়াও বাড়িঘরের অনেক কিছু রেখে যায়, কিন্তু বন্যার পানি সব ধুয়ে মুছে নিঃশেষ করে দেয়, এমনকি বন্যার ভাঙ্গনের ফলে ভিটেবাড়ি জমিও বিলীন হয়ে যায়। ইদানিং সিলেট অঞ্চলে বার বার বন্যা সিলেটের লাখ লাখ মানুষকে চরম অসহায়ত্ব ও বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ সমুদ্র থেকে অনেক দূরে ও উঁচুতে অবস্থিত এই সিলেট অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে এতো ঘন ঘন বন্যা হওয়ার কথা নয়। অনেকের মতে, সিলেট অঞ্চলের বন্যা যতটা না প্রাকৃতিক তার চেয়ে বেশী মানবসৃষ্ট। আর এভাবে উপর্যুপরি যদি বন্যা হয়, তবে দেশের এই তুলনামূলক সমৃদ্ধ, বিত্তবান অঞ্চলও একসময় একটি পশ্চাদপদ ও দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলে পরিণত হতে পারে। এমন আশংকা সচেতন মহলের।
ইতোমধ্যে সিলেটে বৃষ্টিপাত কমেছে। বন্যার পানিও নামছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। কিন্তু বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও জলবায়ু গবেষকদের আশংকা, দুই দফা বন্যার পানি সরে যাওয়ার আগেই জুনের শেষ দিকে উজানের ঢলে ও ভারী বৃষ্টিতে আবারও হতে পারে বন্যা। জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এসব দুর্যোগ মোকাবেলা করেই শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মানুষকে টিকে থাকতে হচ্ছে। শুধু টিকে থাকাই নয়, এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে উন্নতি ও অগ্রগতির চেষ্টা করতে হচ্ছে। ইদানিং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনাও বেড়েছে। বেড়েছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। ২০২২ সালে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ২৬০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। প্রাণহানির বিবেচনায় ২০২২ সালের শীর্ষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল বন্যা।
যা-ই হোক, বাংলাদেশে বন্যা ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ও মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজন একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। এতে সময় ও অর্থ উভয়ই প্রয়োজন। কিন্তু এজন্য পিছপা হলে আরো খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে ভবিষ্যতে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা বা কমানোর জন্য বিশ্বব্যাপী প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের উপর বিনিয়োগ বেড়েই চলেছে। ২০১২-২০১৮ অর্থ বছরে বন্যা ও বন্যার প্রভাব কমানোর জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নেচার বেইসড সমাধানের উপর ৩৪টি প্রকল্পে ১.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। টাইফুন হাইয়ানের পর ফিলিপিন্স সরকার ম্যানগ্রোভ ও প্রাকৃতিক বীচ বন সংরক্ষণে ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে। ২০১১ সালের ভয়াল ভূমিকম্প ও সুনামির পর জাপান সরকার উপকূলবর্তী বন সম্প্রসারণে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন জাপানিজ ইয়েন ব্যয় করে।
বছর তিনেক আগে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাকৃতিক সমাধান ও করণীয়’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ এবং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের অধ্যাপক ড. রঞ্জন রায়ের বেশ কিছু বক্তব্য সময়ের বিবেচনায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্র্যাকটিক্যালি কী কী পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক? এমন প্রশ্নের জবাবে বড় দাগে বলতে হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নদীর নাব্যতা বাড়ানো। নদীর গতিপথ পরিস্কারের জন্য উন্নতি প্রযুক্তিতে ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা ও পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। নদীর নাব্যতা বাড়ানো কোথায় হবে ও কীভাবে হবে তা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে করতে হবে। এক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক গবেষণা ও প্রযুক্তির মধ্যে সমন্বয় আবশ্যক। এক্সপার্টরা বলেছেন, গভীরতা বাড়ানোর জন্য নদীর ‘প্রাকৃতিক শক্তিকে’ ব্যবহার করতে হবে। তিনি আরো বলেন, বন্যা ও জলাবদ্ধতার যে কারণগুলো মানুষের সৃষ্টি তার সমাধানে সরকারের ধারাবাহিক পদক্ষেপ দরকার। বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদী, খাল, বিল, হাওর ও অন্যান্য জলাভূমি দখলমুক্ত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। শহরের আশেপাশে জলাভূমি ভরাট করে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক পথ রোধ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ অনেক জেলা শহরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। শহরে জলাবদ্ধতা কমাতে হলে এলাকাভিত্তিক সমাধান না খুঁজে পুরো নগরী ও আশপাশের এলাকার জন্য সঠিক পরিকল্পনা, নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
অধ্যাপক ড. রঞ্জনের উপরোক্ত বক্তব্যে সিলেট অঞ্চলের বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন বা দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা বছর আগে দেয়া হলেও বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। বন্যা নিয়ন্ত্রণে যে নদী খনন ও জলাবদ্ধতা দুরীকরণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করবেন, এমন প্রত্যাশা আমাদের। আমরা এদিকে সরকারের শীর্ষ ও নীতি নির্ধারক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।