সিলেটে বার বার বন্যা : থমকে গেছে জীবনযাত্রা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ জুলাই ২০২৪, ২:০৬:২৭ অপরাহ্ন
* ষষ্ঠবার ডুবছে নগর * সিলেট ও সুনামগঞ্জে অবনতি *
* মৌলভীবাজারে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে লোকালয় প্লাবিত *
স্টাফ রিপোর্টার : ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষত-ই কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। এরমাঝে এবার পরপর তিন দফা বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট। বৃষ্টি আর ভারতীয় ঢলের কাছে বার বারই হার মানতে হচ্ছে সীমান্তবর্তী এ জনপদকে। এ দুটি যেন এখন এক দু:স্বপ্নের নাম।
বার বার বন্যায় থমকে যাচ্ছে জীবন যাত্রা, অচল হয়ে পড়ছে নগর থেকে গ্রাম। ক্ষতিও হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় সবার মুখেই এখন একটি প্রশ্ন-এই কষ্টের অবসান কবে?
সিলেটে বৃষ্টি থামছেনা। বৃষ্টি হচ্ছে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে। এতে দ্রুত বাড়ছে পানি। সীমা ছাড়িয়েছে বিভিন্ন নদী। বন্যা শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয় দফায় ডুবছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা। আর সিলেট নগরের অবস্থা তো এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
তৃতীয়বার বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে সিলেটের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। রোববার থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হলেও বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিলেট বিভাগে ৮ জুলাই পর্যন্ত তা স্থগিত করা হয়। এমতাবস্থায় আবার প্লাবিত হয়েছে সিলেটের নিম্নাঞ্চল। এমনকি নগরীতেও প্রবেশ করেছে পানি।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের অনেকেই বলছেন, এক দফা পরীক্ষা পেছানো হলেও স্বস্তিতে নেই তারা। বন্যার কবলে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হওয়ায় পরীক্ষার প্রস্তুতিতেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, সিলেটে শেষ ৩৬ ঘন্টায় ৩০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘন্টায় বৃষ্টি হয়েছে ২৯৪ মিলিমিটার। আর মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ১৪ মিলিমিটার। একইসাথে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হচ্ছে অবিরত। ফলে বন্যা পরিস্থতির অবনতি হচ্ছে সময়ে সময়ে। পানিবন্দি হয়ে পড়ছেন লাখ লাখ মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের নদীগুলোতে আগের দিনের তুলনায় গতকাল আরো বেড়েছে পানি। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
কুশিয়ারার আমলশীদ পয়েন্টে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় ৮৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
কুশিয়ারার ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় ৯৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারার শেওলা পয়েন্টে মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া সারি, গোয়াইন নদীর পানিও বিভিন্ন এলাকায় অতিক্রম করেছে।
এতে করে সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার উপজেলার অসংখ্য এলাকা ইতিমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। অনেক জায়গায় রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। কানাইঘাট পৌর শহর পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। শুধু গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রায় ২৪৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এবং ১৫১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সিলেটে বন্যায় ৭ লাখ ১১ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ১৯৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন ৯ হাজার ৫৬৮ জন মানুষ। বন্যায় জেলায় প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা ১ হাজার ১৮৪টি।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাত সিলেটের জন্য শঙ্কার। চেরাপুঞ্জিতে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টায় ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে। সেখানে আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সিলেটেও ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
তিনি বলেন, বন্যা থেকে সিলেটকে উদ্ধার করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। রাতারাতিই পানি চলে আসে সিলেটে। ডুবে যায় সিলেট নগর।
ষষ্ঠবারের মতো ডুবছে সিলেট নগর :
টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি নামতে না পারায় চলতি বর্ষা মৌসুমে ষষ্ঠবারের মতো ডুবেছে সিলেট। নগরের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যেই জলাবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সিলেট নগরের বেশ কিছু এলাকার সড়ক ও বাসাবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে নগরের মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়ি, তালতলা, জামতলা, কুয়ারপা শিবগঞ্জ, শাহজালাল উপশহর, হাওয়াপাড়া, যতরপুর, মেন্দিবাগ, তোপখানা, মজুমদারি, ভাতালিয়া, চৌকিদেখী, দক্ষিণ সুরমাসহ বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা।
এসব এলাকার অনেকে বলেন, এ নিয়ে চলতি মৌসুমে তাদের ঘরে কয় দফা পানি উঠেছে মনে নেই। প্রতিবার পানি ওঠার পর ঘরটি ছেড়ে স্বজনদের বাড়িতে চলে যান।
নগরের শাহজালাল উপশহরের একাধিক বাসিন্দা বলেন, উপশহরে কিছু হলেই পানি উঠে যায়। বাসাবাড়ির নিচতলায় থাকা যাচ্ছে না। এজন্য দ্রুত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, উপশহরে প্রধান সড়ক পর্যন্ত পানিতে তলিয়েছে। বাসাবাড়ির অবস্থা আরও খারাপ।
সিলেটে এর আগে গত ২৮ মে থেকে ভারী বৃষ্টির ফলে প্রথম দফায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে গত ১৬ জুন আবার বন্যা পরিস্থিতিতে দুর্ভোগে পড়েন সিলেটের বাসিন্দারা। সব মিলিয়ে চলতি মৌসুমে গতকাল পর্যন্ত ষষ্ঠবারের মতো জলাবদ্ধ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন সিলেট নগরের বাসিন্দারা।
এ অবস্থায় কোনো সুখবর দিতে পারেনি সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজ। তিনি বলেন, সুরমা তীরবর্তী ১২টি ওয়ার্ডে পানি উঠে গেছে, সময়ের সাথে সাথে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। তবে আমরা প্রস্তুত আছি।
সুনামগঞ্জে অবনতি :
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে নেমেছে উজানের পাহাড়ি ঢল। এ কারণে সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় অনেক রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। শহরের সুরমা নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যার পানি ঢুকেছে। ভাটির এ জনপদে আবার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সুরমা নদীতীরবর্তী সড়ক, বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। শহরের লঞ্চঘাট, জলিলপুর, মল্লিকপুর, উত্তর আরপিননগর, তেঘরিয়া, নবীনগর, ওয়েজখালী, মল্লিকপুর ও বড়পাড়া এলাকা জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে।
পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, শহরে নদী ও হাওর-তীরবর্তী এলাকায় পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকায় রাস্তাঘাট, দোকানপাট ও বাড়িঘরে পানি আছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ঢলের পানিতে তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের তিনটি এলাকা প্লাবিত হওয়ায় সড়কটি দিয়ে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ছাতক উপজেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর, কালারুকা, নোয়ারাই ও চরমহল্লা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। দোয়ারাবাজার উপজেলায় বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামা অব্যাহত থাকায় পানি বাড়ছে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা, পাটনাই, রক্তি, বৌলাই, কুশিয়ারা, নলজুর, চেলা, চলতি, খাসিয়ামারাসহ সব নদীতে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। সুনামগঞ্জ এবং এর উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হওয়ার কারণেই মূলত পানি বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টি হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন থেকে বন্যা দেখা দেয়। একপর্যায়ে পুরো জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। প্লাবিত হয় জেলার এক হাজার ১৮টি গ্রাম। এতে আট লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। অসংখ্য ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়। মানুষের বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে আশ্রয় নেয় ২৫ হাজার পরিবার। ২৩ জুনের পর থেকে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে মানুষ বাড়িঘরে ফেরেন। আবার কেউ কেউ এখনো বাড়িতে ফিরতে পারেননি। এর মধ্যেই আবার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ।
মৌলভীবাজারে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে লোকালয় প্লাবিত:
ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে মৌলভীবাজারে মনু ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার বিকেলে শহরের মনু সেতুর কাছে চাঁদনীঘাটে মনু নদের পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার এবং সদর উপজেলার শেরপুরে কুশিয়ারা নদীর পানি ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
সকালে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা এলাকায় কুশিয়ারার পানি উপচে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে জনপদে প্রবেশ করেছে। এ এলাকায় কুশিয়ারার স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধ নেই। গ্রামীণ সড়কটিই প্রতিরক্ষা বাঁধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নতুন করে ভাঙনের ফলে আশপাশের গ্রামগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার রাত থেকে মৌলভীবাজারে মনু, কুশিয়ারাসহ জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে পানি বাড়তে শুরু করে। মনু নদের পানি মৌলভীবাজার শহরের মনু সেতুর কাছে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমার ৯ দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। একই জায়গায় মঙ্গলবার বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছিল।
অন্যদিকে সদর উপজেলার শেরপুরে সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় কুশিয়ারা নদীর পানি ছিল ৮ দশমিক ৪৯ সেন্টিমিটার বা বিপদসীমার নিচে। মঙ্গলবার সেখানে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুরের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ উপচে পানি ঢুকছে। এর মধ্যে গতকাল সকালের দিকে হামরকোনা মসজিদের কাছে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে। ফলে গ্রামের ভেতর পানি প্রবেশ করছে। জুড়ী নদীর পানি অনেক দিন ধরেই বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল বিকেলে জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ১৭৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল বলেন, কুশিয়ারার পানি বাড়াটা ভয়ের। কুশিয়ারায় পানি বাড়লে মনুর পানি কমবে না। কুশিয়ারা নদীর খলিলপুর এলাকায় পাউবোর স্থায়ী কোনো বেড়িবাঁধ নেই। হামরকোনায় এলজিইডির রাস্তা ভেঙে খলিলপুর ইউনিয়নে পানি ঢুকছে।