প্রলম্বিত বন্যায় বেহাল জীবন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুলাই ২০২৪, ৪:০০:৫২ অপরাহ্ন
* বৃষ্টি কমলেও নামছে না পানি * সুরমা-কুশিয়ারা এখনো বিপদসীমায়
স্টাফ রিপোর্টার : প্রলম্বিত হচ্ছে বন্যা। বৃষ্টিপাত কমলেও বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখ করার মতো কোন উন্নতি হয়নি। উল্টো কুশিয়ারার পানি প্রবাহ বেড়েছে। সুরমাও বিপদসীমায়। হাওরগুলোও যেন আর পানির ভার নিতে পারছেনা। এ অবস্থায় পানিবন্দী মানুষের মাঝে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।দীর্ঘস্থায়ী এই বন্যা আক্রান্ত মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। অনেকে মনে করছেন, পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় বন্যা প্রলম্বিত হয়েছে।
দিনের পরদিন থেকে কেউ গৃহহারা, আবার কেউ নিজ ঘরেই পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর বেহাল অবস্থা। গো-খাদ্যের সংকটে গবাদিপশু নিয়ে তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। অনিশ্চয়তায় পড়েছে জমিচাষ। এছাড়া অন্যান্য পেশার মানুষের মাঝেও চরম হতাশা বিরাজ করছে। পানিবন্দী অবস্থায় কাজ-কর্মহীন স্তব্ধ জীবনযাপন করছেন তারা।
এদিকে, গত চার দিন ধরে সিলেটের প্রধান দুই নদীর পানি ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও শনিবার দুপুর ১২টা থেকে দুইটি পয়েন্টে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদ-নদীর পানি নামলেও হাওর-বাওর ও বাড়ি-ঘরে উঠা পানি নামছেনা। আর কোন কোন স্থানে ধীরগতিতে পানি নামায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি বোঝা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়া বার্তায় আজ রোববার পর্যন্ত বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে জানিয়ে আবহাওয়া অফিস বলেছে, কোথাও কোথাও বৃষ্টির প্রবণতা বাড়তে পারে। সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়তে পারে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, এখন যেহেতু বর্ষা মৌসুম, তাই প্রতি বছরই এ সময়ে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বন্যা হয়। ৯০ শতাংশের বেশি পানি আসে ভারত থেকে। বর্ষা মৌসুমে এই পানি আসার প্রভাবে বন্যা পরিস্থিতি তীব্র হচ্ছে। বন্যা থাকবে এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে আগস্ট মাসেও বন্যার ঝুঁকি রয়েছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় পানি বিপদসীমার ৬২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একইসময় কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টে পানি ২৪ সেন্টিমিটার ওপরে, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে পানি শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমার লেবেলে প্রবাহিত হচ্ছিল।এদিকে, কুশিয়ারার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই। সিলেট নগরসহ গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও ওসমানীনগরসহ অন্যান্য উপজেলায়ও পানি নামছে বেশ ধীরে।
জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর পাঁচটি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে প্রায় একশ’র বেশী গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। একই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পানি উপচে প্রবেশ করছে। ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার এখনো পানিতে নিমজ্জিত আছে। বিয়ানীবাজার উপজেলায়ও বিভিন্ন এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে প্রবেশ করছে। এতে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বালাগঞ্জ বাজারও পানিতে নিমজ্জিত। মানুষজন নৌকায় করে বাজার করছেন এসব এলাকায়।
এসব এলাকা ব্যবসায়ী ও মানুষজন বলেছেন, বাজারে পানির মধ্যেই তাঁরা ব্যবসা পরিচালনা করছেন। পানির মধ্যেই চলাফেরা করতে হচ্ছে সবাইকে। এর ফলে চর্মরোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শিশু-বৃদ্ধদের অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু ত্রাণ তৎপরতা ও চিকিৎসা সেবা নেই বললেই চলে। যা হচ্ছে তা লোক দেখানো ও ফটোসেশন ছাড়া কিছুই নয়।
জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবদুল আহাদ বলেন, কুশিয়ারা নদীর ভয়াবহ স্রোতে কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। এতে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন চেষ্টা করেও বাঁধটি রক্ষা করতে পারেননি। তিনি বলেন, কুশিয়ারা নদীর পানি না কমা পর্যন্ত বাঁধটি মেরামত করা সম্ভব হবে না। এর ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দুর্ভোগ সহসা কমছে না।
এদিকে সিলেট নগরের বেশ কিছু এলাকা জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে। শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, মীরাবাজার, তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়িসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার কিছু অংশে এখনো পানি আটকে আছে। পানি নামছে ধীরে। আর যে এলাকা থেকে পানি নামছে সেখানে উৎকট দুর্গন্ধ ও ক্ষত বেরিয়ে আসছে।
সোবহানীঘাট, তালতলা, জামতলা ও তেররতন এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলেন, বৃষ্টি কমে আসায় জলাবদ্ধ পানি কালো রং ধারণ করেছে। ময়লা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এর মধ্যেই তাদের চলাফেরা করতে হচ্ছে। এতে অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তাদের।
নগরের জামতলা এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ঘরের একটি কক্ষে আজ সকাল পর্যন্ত পানি আছে। আবার বৃষ্টি হলে পানি বেড়ে যেতে পারে। এমন অবস্থায় বৃষ্টি যেন আর না হয় সে আশা করা ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।
সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, গতকাল শনিবার পর্যন্ত জেলার ২১৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৯ হাজার ৮৩১ জন আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যায় এর মধ্যে ১ হাজার ১৩৯টি গ্রাম প্লাবিত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, বৃষ্টিপাত কমে আসায় পানি নামতে শুরু করেছে। তবে ধীরগতিতে পানি নামছে।
এদিকে, সুনামগঞ্জে গত দুইদিন ভারী বৃষ্টি হয়নি এবং একই সময়ে পাহাড়ি ঢল কম নামায় নদী ও হাওরে পানি কমছে। তবে হাওরে পানি কমছে ধীরে। এখনো অনেক বাড়িঘর ও রাস্তাঘাটে পানি আছে। এতে মানুষের ভোগান্তি কমছে না।
বন্যার পানিতে প্লাবিত থাকায় সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কে এখনো সরাসরি যান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। তবে পানি নেমে যাওয়ায় সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়ক দিয়ে যান চলাচল করছে। তবে এখনো তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর, সদর উপজেলার নিচু এলাকা মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটে পানি আছে। মানুষজন নৌকা নিয়ে চলাফেরা করছেন। এতে ভোগান্তি বেড়েছে।
সুনামগঞ্জে গত ১৬ জুন থেকে বন্যা দেখা দেয়। একপর্যায়ে পুরো জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। প্লাবিত হয় জেলার ১ হাজার ১৮টি গ্রাম। ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। অসংখ্য ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়। মানুষের বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে আশ্রয় নেয় ২৫ হাজার পরিবার। ২৩ জুনের পর থেকে নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেন। কিন্তু মানুষ স্বস্তি ফেলার আগেই আবার বন্যা পরিস্থিতি আবার অবনতি হয়ে যায়।
দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা নদীতে নৌকাডুবিতে মা-মেয়েসহ নিখোঁজ তিনজনের মধ্যে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার সকালে সদর উপজেলার সুরমা নদীর ব্রাহ্মণগাঁও এলাকা থেকে ভাসমান লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। এ নিয়ে ওই দুর্ঘটনায় দুজনের লাশ উদ্ধার করা হলো। তবে নিখোঁজ শিশু হাবিবার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।এদিকে, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে কুশিয়ারা-কালনী নদীর পানির প্রবল স্রোতে কৈয়ারঢালা স্লুইচ গেট সংলগ্ন সড়কের একটি অংশ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বদলপুর ও কাকাইলছেও ইউনিয়ন এবং পাশের বানিয়াচং, নবীগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার হাওর ও নিম্নাঞ্চল।
বিভিন্ন এলাকা বানের পানিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো সেগুলো পাঠদানের উপযোগী হয়নি। জেলার অনেক হাইস্কুলে মূল্যায়ন পরীক্ষা হয়নি।