আজ পবিত্র আশুরা: একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০২৪, ১২:১৯:০৬ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: আজ পবিত্র আশুরা। মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিনগুলোর একটি হলো আশুরা। আশুরা আরবী শব্দ এর সহজ বাংলা অর্থ হলো দশমী। নানান ঐহিতাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে এই দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এইদিনে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে যার কারণে সেই আদি কাল থেকে এই দিনটি মুসলমানদের বাইরেও বিভিন্ন জাতির কাছে একটি বিশেষ দিন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এই পৃথিবীর অস্তিত্বের সাথেও আশুরার দিনের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। আশুরার দিনেই আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন আকাশমালা, মর্তজগৎ, পর্বতরাজি, লওহ-কলম ও ফেরেশতাদের। আশুরার দিনে আল্লাহ তায়ালা আরশে আজিমে অধিষ্ঠিত হন। আকাশ থেকে প্রথম বৃষ্টিপাত হয় এ দিনেই। শুধু সৃষ্টির সাথেই নয়, বরং প্রলয়ের সাথেও রয়েছে এ দিনের সম্পর্ক। রাসূলুল্লাহ সা.এর ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, কিয়ামত সংঘটিত হবে মহররম মাসের ১০ তারিখ জুমার দিন। এভাবে পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ দিনের সাথে সম্পর্ক।
আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ চারটি মাসের একটি হলো মহররম মাস আর এই মহররমের দশ তারিখ হলো আশুরা। আবুবকর রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিস। রাসূল সা. বলেছেন, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই সময় একই নিয়মে আবর্তিত হচ্ছে। বছর বারো মাসে। তারমধ্যে চার মাস সম্মানিত ও মর্যাদাসম্পন্ন। তিনটি হলো, পরপর আর সেগুলো হচ্ছেÑ জুলকা’দাহ, জুলহিজ্জাহ ও মহররম। আরেকটি হলো রজব।
তাই আমাদের মহররম মাসের সম্মান দিতে হবে আর রাসূল মুহাম্মদ সা. এর নির্দেশনা অনুযায়ী এ মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যম হলো আশুরার সিয়াম পালন। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। নবী সা. মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরা দিবসের সিয়াম পালন করছে। তাদের এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তারা বললো, এ দিনে আল্লাহ ফেরাউনের বিরুদ্ধে মূসা আলাইহিস সালাম ও বনি ইসরাঈলকে বিজয় দিয়েছিলেন। এর সম্মানে আমরা সিয়াম পালন করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমাদের তুলনায় মূসার সাথে তো আমার অধিকার বেশি।’ এরপর তিনি এ দিন রোজা রাখার জন্য আদেশ করলেন। ইহুদিদের আমলের বিপরীতে দশম ও নবম তারিখে রোজা রাখা সর্বোত্তম। সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আশুরা দিবসের সিয়াম তথা রোজা সম্পর্কে আল্লাহর কাছে আমি এমনটি আশা করি যে তিনি বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’
নানান কারণে আশুরা দিন মুসলিম উম্মার কাছে একটি বিশেষদিন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মানবজাতির আদি পিতা আদম আ. কে খলিফা হিসেবে সৃষ্টি, জান্নাতে অবস্থান, পৃথিবীতে প্রেরণ ও তাওবা কবুল। নূহ আ. এর সময়কার মহাপ্লাবনের পর নৌকা ৪০ দিন পর জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মাটি স্পর্শ করে ঐতিহাসিক আশুরার দিন। এ দিনেই ইবরাহিম আ. এর জন্ম, ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত হওয়া ও নমরুদের অগ্নি থেকে রক্ষা পাওয়া। ইদ্রিস আ. কে বিশেষ মর্যাদায় চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয় আশুরার দিনে। সুদীর্ঘ ৪০ বছর পর ইউসুফ আ. এর সাথে তার পিতা ইয়াকুব আ. এর সাক্ষাৎ যে দিন হয় সে দিনটি ছিল আশুরার দিন। নবী আইয়ুব আ. দীর্ঘ ১৮ বছর কুষ্ঠরোগ ভোগ করার পর আরোগ্য লাভ করেছিলেন আশুরার দিন। ইউনুস আ. ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর মুক্তি লাভ করেন আশুরার দিন। ঘটনাক্রমে সুলায়মান আ. সাময়িক রাজত্ব হারা হন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আবারো রাজত্ব ফিরিয়ে দেন আশুরার দিনে। আল্লাহ তায়ালা মূসা আ. ও তাঁর অনুসারী বনি ইসরাইলদেরকে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে পানির মধ্যে রাস্তা তৈরি করে দিয়ে পার করে দেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ সাগরে ডুবিয়ে মারেন আশুরার দিন। মূসা আ. তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে কথা বলেছিলেন আশুরার দিনে। এ দিনে ঈসা আ.এর জন্ম হয় এবং ইহুদিরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ফেরেশতা দিয়ে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন এ দিনেই। পবিত্র কাবা শরিফে সর্বপ্রথম গিলাফ দ্বারা আবৃত করা হয়েছিল আশুরার দিন।
তবে বর্তমান সময়ে আশুরার দিনটি যে কারণে বিশ্ব মুসলিমের কাছে অত্যন্ত স্মরণীয় এবং পাশাপাশি শিক্ষণীয় তা হলো হৃদয়বিদারক কারবালার ঘটনা। যে ঘটনার মাধ্যমে হোসাইন রা. শাহাদাত বরণ করেন। মুয়াবিয়া রা. এর ইন্তেকালের পর মদিনাবাসীর মতামত না নিয়েই ইয়াজিদ ইসলামী রাষ্ট্রনীতির বরখেলাফ করে দামেস্কের মসনদে আসীন হন। যে নীতি-আদর্শ মহানবী সা. প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং খোলাফায়ে রাশেদিন যে নীতির আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন ইয়াজিদের দ্বারা সে নীতি-আদর্শ পরিবর্তিত হওয়ায় হোসাইন রা. তা রক্ষার জন্য সোচ্চার হলেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহ সা. এর দৌহিত্র হোসাইন রা. অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সত্যের জন্য সংগ্রাম করে কারবালার প্রান্তরে সপরিবারে শাহাদতবরণ করে সর্বোচ্চ ত্যাগের অতুলনীয় আদর্শ রেখে যান।
আশুরার তাৎপর্য সম্পর্কে ইমাম জাফর আস-সাদিক র. বলেন, ‘প্রতিটি দিনই আশুরা, প্রতিটি মাসই মহররম এবং প্রতিটি ভূমিই কারবালা।’ প্রতিটি দিনই আশুরা মানে আশুরার শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রতিদিনই আমাদের কিছু কর্মসূচি থাকা আবশ্যক। প্রতিটি মাসই মহররম অর্থ কারবালার চেতনা শুধু মহররম মাসে সীমিত রাখলেই চলবে না, প্রতিটি মাসেই এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সত্যের জন্য সংগ্রাম করে যেতে হবে। প্রতিটি ভূমি কারবালা অর্থ হচ্ছে প্রতিটি ভূমিকে কারবালা মনে করে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে কারবালার চেতনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
তাই আশুরার শিক্ষা হিসেবে বলা যায় আশুরার দিনটি মূলত বাতিলের পরাজয় এবং সত্যপন্থী, হকপন্থীদের বিজয় ও মুক্তির দিবস। এজন্য নবী ও তাঁদের অনুসারীদের ইতিহাস স্মরণ করে আল্লাহর বিধান পালন ও বাস্তবায়নে অবিচলতা, দৃঢ়তা ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা যথার্থমানের হতে হবে। তাহলে এখনো আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সব বাতিল শক্তির মোকাবেলায় মুসলিমদের বিজয়ী করবেন। ঈমান-আকিদাবিরোধী সব কার্যকলাপ বন্ধ করতে সচেষ্ট হতে হবে। মুসলিম নামধারী হয়েও যারা ইয়াজিদ, ইবনে জিয়াদ ও সিমারের ভূমিকা পালন করছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। ইসলাম সম্পর্কে যারা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে তাদের সঠিক ধারণা প্রদান করতে হবে এবং ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে সবাইকে আহ্বান জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে নিজেদের কুরআন সুন্নাহর নিয়মিত চর্চার দ্বারা ইসলামের যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সুস্থ ও মননশীল সংস্কৃতি চর্চা ও প্রচারের মাধ্যমে অপসংস্কৃতির বিভীষিকা রোধ করতে হবে। সত্য ও ন্যায়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে বাতিলের মোকাবেলায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে।