সবার উর্ধ্বে দেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:৩০:২০ অপরাহ্ন
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলো ছিল এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ। অনেকেই ভেবেছিলেন যেহেতু দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাই এমন দৃশ্যের আর পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা নেই। অনেকে আবার আফসোস করেছেন, এমন ঐতিহাসিক সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষী হতে না পারার কারণে। কিন্তু বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে যে উত্তেজনা ও উত্তাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেকের কাছে সেই একাত্তরের দিনগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এমন অবস্থা সৃষ্টির পেছনে সরকার তথা ক্ষমতাসীন মহলের নানা ধারণা ও যুক্তি থাকতে পারে। মাঝে মাঝে তারা তা প্রকাশও করছেন। গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করে বলেছেন, একটি মহল ঢাল হিসেবে এবং ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ব্যবহার করছে। তিনি বিরোধী দলগুলোকে ইঙ্গিত করেই এমনটি বলেছেন, এমন অভিমত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
যা-ই হোক, গতকাল গোটা দেশব্যাপী যেভাবে আন্দোলন বিস্তৃত হতে দেখা গেছে, এতে এটাকে শুধু ছাত্র নয়, বরং গণমানুষের দাবি আদায়ের আন্দোলন হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এর আগে ফ্রান্সের একটি বিখ্যাত পত্রিকা এই আন্দোলনকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আন্দোলন দমনে সরকারের কঠোর রক্ত ঝরানো নীতি ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিশ্বের সকল মানবাধিকার সংস্থা। বিশ্বসংস্থা জাতিসংঘও এ বিষয়ে কড়া হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ ছাত্রদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গণহত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। নিহত আন্দোলনকারীদের সংখ্যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি রয়েছে। সংঘাত সংঘর্ষের সময় ইন্টারনেট ও অন্যান্য ডিজিটাল যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখার দরুন এ নিয়ে সন্দেহ সংশয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। সরকার থেকে নিহতের যে শংকা বলা হচ্ছে, আন্দোলনকারীরা তা নাকচ করে এর চেয়ে বেশী মানুষ নিহত হওয়ার দাবি করছেন। আর বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য মূলত: সরকারই দায়ী। ইন্টারনেট বন্ধ না করলে এবং সঠিক সংখ্যা তুলে ধরলে এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টির কোন কারণ ছিলো না। কেউ তিলকে তাল বানাতে অর্থাৎ গুজব ছড়ানোর সুযোগ পেতো না।
একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, সরকার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রকৃত তথ্য ও সত্য গোপনের কৌশল অবলম্বন করে আসছে তাদের শাসনামলের শুরু থেকেই। অতি সম্প্রতি রফতানী আয়, রিজার্ভের পরিমাণ ও খেলাপী ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে তাদের লুকোচুরি ও ধামাচাপা দেয়ার প্রবণতা মানুষের মনে ক্ষমতাসীনদের দেয়া তথ্য, বক্তব্য ও বিবৃতি সম্পর্কে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে, যার শেকড় এখন অনেক গভীরে চলে গেছে। এই সুযোগে অনেক গুজবও ডালপালা মেলার সুযোগ পাচ্ছে।
বলা বাহুল্য, গতকালের বিক্ষোভ আন্দোলন দেখে অনেক বিশ্লেষক এই বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আন্দোলনের মাত্রা ও গতি শুধুই বাড়ছে। ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করলেও এতে এখন অভিভাবক শিক্ষক তথা সাধারণ মানুষ এসে যুক্ত হচ্ছেন ক্রমবর্ধমান হারে। এ অবস্থায় সরকার, ক্ষমতাসীন দল মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে দেশের সাধারণ মানুষের। কিন্তু এমনতো হবার কথা ছিলো না, কথাও নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণ ও সরকার পরস্পর বিরোধী অবস্থানে থাকবে, এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বেলা শেষে দেশটা তো সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও সাধারণ জনগণের। দেশের ক্ষতি তো তাদের সকলের ক্ষতি। তাই দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে এমন মুখোমুখি অবস্থান থেকে সরে আসা উচিত সংশ্লিষ্ট মহলের। দেশের জনগণের আশা আকাংখা ও প্রত্যাশার প্রতিফলন যাতে ঘটে এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত সরকারের প্রতিটি সংস্থা ও বিভাগের। কোনভাবেই যাতে দেশে একটি গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে সবাইকে। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে সবাইকে। কথায় আছে, সংঘাত শুধুই সংঘাত ডেকে আনে, আর হত্যা ডেকে আনে আরো হত্যা।
আমরা আশা করবো, যেহেতু এই দেশ আমাদের সকলের। এদেশের কল্যাণে ও মঙ্গলের উপর আমাদের কল্যাণ ও মঙ্গল নিহিত, তাই এমন কিছু করা বা এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত হবে না, যা দেশ ও জনগণের জন্য অমঙ্গল ও ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনে। এ মুহূর্তে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশী। আমরা আশা করবো ক্ষমতাসীন মহল তথা সরকার দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করবেন।