বিক্ষোভে ছাত্র-জনতার স্রোত : সরকার পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ আগস্ট ২০২৪, ১২:২০:১২ অপরাহ্ন
লোকারণ্য ঢাকা শহীদ মিনার, সিলেটেও ঢল
জালালাবাদ রিপোর্ট : কোটা সংস্কারের দাবি ঘিরে শুরু হওয়া আন্দোলন এখন সরকার পতনের এক দফায় রূপ নিয়েছে। শনিবার রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সিলেটসহ প্রায় সব বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হয়েছে। জন¯্রােতে রূপ নেয়া এ কর্মসূচীতে মিছিল শ্লোগানে একাকার হয়েছে ছাত্র-জনতা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ছাত্র-জনতার ঢল যেন সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। লাখো শিক্ষার্থী-জনতার ¯্রােত মিশে যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।
আর ঢাকা শহীদ মিনার থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগের একদফা দাবি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনটির সমন্বয়ক মো. নাহিদ ইসলাম ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই ঘোষণা দেন।
শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শহীদ মিনারে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে বক্তব্য দেন নাহিদ। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আমরা খুব দ্রুতই ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের জন্য সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্রসংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করব। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা আমরা সবার সামনে হাজির করব।
‘শুধু শেখ হাসিনা নন, মন্ত্রিসভাসহ পুরো সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। এই ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিলোপ করতে হবে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই, যেখানে আর কখনো কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে।
যে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে, তার সঙ্গে মানুষকে যোগ দেওয়া এবং পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান নাহিদ। তিনি আজ রোববার থেকে সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
নাহিদ বলেন, সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলবে। সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তাবাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, এই সরকারকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। আপনারা সরকারকে সমর্থন না দিয়ে জনগণকে সমর্থন দিন।
ঢাকার গণমাধ্যম সূত্রগুলো বলছে, শনিবারের ঢাকা ছিলো কার্যত ছাত্র-জনতার দখলে। এ যেন এক অন্য রকম দৃশ্য। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। কোথাও এতটুকু জায়গা ফাঁকা ছিলো না। হাজারো মানুষের ভিড়ে শহীদ মিনার চত্বর ও এর আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকার পা ফেলার জায়গা ছিলোনা।
শহীদ মিনার এলাকায় উপস্থিত অনেকে জানান, শনিবার বেলা আড়াইটার পর থেকে দলে দলে শহীদ মিনারে জড়ো হতে শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। সময় যত গড়াতে থাকে, আন্দোলনকারীদের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে।
এসময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ছিলো নানা শ্লোগান। ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে,’ ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস,’ ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত,’ ‘স্বৈরাচারের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে,’ ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো,’ ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, অভ্যুত্থান’, ‘পদত্যাগ পদত্যাগ, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ এমন নানা স্লোগান দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হতাহতের ঘটনায় ৯ দফা দাবি দিয়েছিল। এবার এক দফা দাবি তুলে ধরা হলো। আজ শহীদ মিনারে সামনের সারিতে অন্তত ছয়জন সমন্বয়ক উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও আবদুল কাদের। তাঁদের মধ্যে নাহিদসহ তিনজন বক্তব্য দেন।
এর আগে সকালে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের নেতারা। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আমি বসতে চাই। তাদের কথা শুনতে চাই। আমি সংঘাত চাই না।
অন্যরকম এক রাজধানী :
কাল গোটা রাজধানী ছিলো যেন অন্যরকম এক নগরীর নাম। যেখানে ক্ষমতাসীন দল ছাড়া এতদিন কেউ দাঁড়াতেই পারেনি, সেই ঢাকা কাল ছিলো ছাত্র-জনতার নিয়ন্ত্রণে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রাজধানীর সবকটি এলাকা থেকে মিছিল আসতে শুরু করে সকাল থেকেই। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন আন্দোলনকারীরা। বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড় থেকে আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে রওনা হন। বেলা তিনটার দিকে সায়েন্স ল্যাব থেকে কয়েক হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে শহীদ মিনার এলাকায় উপস্থিত হন।
এসময় সময় হাজার হাজার মানুষের মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত হয় পুরো এলাকা। একদিকে জগন্নাথ হল, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার, আরেক দিকে দোয়েল চত্বর ছাড়িয়ে যায় জনতার ঢল। উপস্থিত সকল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাথায় ও হাতে দেশের লাল-সবুজের পতাকা বাঁধা দেখা গেছে।
এর আগে সকাল থেকে রাজধানীর আফতাবনগর, বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী, মিরপুর-১০ ও সায়েন্সল্যাবে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এতে অভিভাবকসহ সাধারণ জনতাও যোগ দেন।
আফতাবনগরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে জড়ো হন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বনশ্রী বি ব্লকের সামনে আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগন দিতে থাকেন।
কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রাজধানীর বাড্ডা রামপুরা সড়কে অবস্থান নেন। এ সময় বাড্ডা থানার অর্ধশতাধিক পুলিশ রাস্তা থেকে সরে যায়। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইউআইটিএস ও সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অংশ নেন।
এছাড়া সায়েন্সল্যাবে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সকাল থেকে অনেক পুলিশ সদস্যকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নিহত, গণগ্রেপ্তার ও হয়রানির প্রতিবাদে ব্যান্ড সংগীতশিল্পীরা বেলা তিনটায় ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে জড়ো হন। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানাতে সংগীতশিল্পীরা শহীদ মিনারে রওনা দেন। মিছিল নিয়ে বিকেল পৌনে চারটার দিকে তাঁরা শহীদ মিনার এলাকায় পৌঁছান।
সিলেটে দিনভর শান্তিপূর্ণ, শেষ বিকেলে পুলিশের গুলি :
সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ কর্মসূচীতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ঢল নামে। বৃষ্টি উপেক্ষা করে চৌহাট্টা-জিন্দাবাহার সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। সময় যত বাড়ে জমায়েতও তত বাড়ে।একপর্যায়ে পুরো জিন্দাবাজার, চৌহাট্টাসহ আশপাশ এলাকা দখলে চলে যায় তাদের।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে তারা নানা শ্লোগান দেন। কিন্তু জনতার স্রোতে মিশে যাওয়া শহীদ মিনার এলাকায় বিকেল ৫টার দিকে হঠাৎ আক্রমনে যায় পুলিশ। মুহূর্মহ ছুঁড়তে থাকে টিয়ার শেল, শর্টগানের গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড। বেধে যায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা দুইটা থেকে নগরের চৌহাট্টা এলাকায় শহীদ মিনারের সামনের সড়কে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি শুরু হয়। বেলা পাঁচটার দিকে পুলিশকে সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শটগানের গুলি ছুড়তে দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পুলিশের বাধায় আন্দোলনকারীরা চৌহাট্টা থেকে নয়াসড়ক, জিন্দাবাজার ও দরগা গেটমুখী সড়কের দিকে ভাগ হয়ে যায়। তিন দিক থেকে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ চলে। এ সময় গণমাধ্যমকর্মী ও অনেক শিক্ষার্থীকে আহত হতে দেখা গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে কারও পরিচয় জানা যায়নি। পুলিশ সদস্যও আহত হওয়ার খবর জানা যায়।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি, শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলেন। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশ চড়াও হয়ে আক্রমণ শুরু করলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মো. আজবাহার আলী শেখ বলেন, শিক্ষার্থীরা শুরু থেকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করায় পুলিশ বাধা দেয়নি। একপর্যায়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এখন চেষ্টা করে।
এদিকে, দুপুরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় শিক্ষার্থী, জনতা, সাংবাদিক ও পুলিশসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, উপজেলা সদরে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা এসে বাধা দেয়। এ সময় কয়েক দফা সেখানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।