সাংবাদিক তুরাব হত্যার ৩ সপ্তাহ পার, অধরা দায়ী পুলিশ সদস্য
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:১০:২২ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : দেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশের ন্যায় সিলেটেও ঝরেছে একাধিক প্রাণ। মৃত্যুর মিছিল থেকে বাদ যাননি সাংবাদিকও। সকল হত্যার বিচার হবে সেনাপ্রধানের এমন আশ্বাসে আশায় বুক বাঁধছেন সিলেটের সম্ভাবনাময় তরুণ সাংবাদিক এটিএম তুরাবের পরিবার ও সাংবাদিক সমাজ। যদিও ঘাতক পুলিশ সদস্যরা এখনো রয়ে গেছেন অধরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে সিলেটে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের গুলীতে নির্মমভাবে নিহত সাংবাদিক এটিএম তুরাব হত্যার ৩ সপ্তাহ পার হয়েছে। অথচ এখনো অধরাই রয়ে গেছে দায়ী পুলিশ সদস্যরা। এ নিয়ে সাংবাদিকদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে দায়ীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবী তুরাবের পরিবার ও সাংবাদিকদের।
গত ১৯ জুলাই শুক্রবার বাদ জুমআ সিলেট নগরীর কোর্টপয়েন্ট এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল বের করে বিএনপি। তখন মধুবন মার্কেট সংলগ্ন পুরানলেনের পার্শে¦ রাস্তায় প্রেস লেখা কটি (ভেস্ট) ও হেলমেট পরে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছিলেন দৈনিক জালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার ও দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি এটিএম তুরাব। কোনধরনের উস্কানী ছাড়াই তখন এসএমপির এডিসি (উত্তর) সাদেক কাউসার দস্তগীরের নেতৃত্বে মিছিলে অতিউৎসাহি পুলিশ নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করে। যার ভিডিও ও ছবি অনেক সাংবাদিকের কাছে রয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ঐ ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, এসএমপির এডিসি উত্তর সাদেক কাউসার দস্তগীর এক পুলিশ কনস্টেবলের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে এটিএম তুরাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েন। এরপর গুলিবিদ্ধ তুবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পুরানলেন’র মুখে সড়কে চালকের ফেলে যাওয়া একটি সিএনজি অটোরিকশার আড়ালে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বসে পড়েন। সাংবাদিকদের সাহায্য চান। তখন দৈনিক মানবজমিনের ফটো সাংবাদিক মাহমুদ হোসেনসহ অন্যান্য সাংবাদিকরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু তখনো কেউ বুঝে ওঠতে পারেননি এই তরুণ সাংবাদিকের জীবনমৃত্যুর দুয়ারে। তাকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেদিন শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় কোনো চিকিৎসক পাননি। উপস্থিত নার্সরা তাকে তাৎক্ষনিক চিকিৎসা দেন। সেখানে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে দ্রুত ইবনে সিনা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্তুাবধানে আইসিইউ-এ চিকিৎসাধিন থাকা নঅবস্থায় ঐদিন সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটের সময় তুরাব ইন্তেকাল করেন। পরদিন ২০ জুলাই শনিবার বাদ আসর বিয়ানীবাজার পৌরসভার ফতেহপুর ঈদগাহ ময়দানে ২য় জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে ঐদিন বাদ জোহর নগরীর মানিকপীর (র.) মাজার সংলগ্ন এলাকায় তার প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়।
তুরাবের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. শামসুল ইসলাম বলেন, তুরাবের শরীরে ৯৮টি ছররা গুলীর চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায়ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
ভাইয়ের মামলাকে জিডি মূলে তদন্ত :
সাংবাদিক এটিএম তুরাবের মৃত্যুর ঘটনায় গত ২৪ জুলাই বুধবার রাতে সিলেটের সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্বশীল ৭টি সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে এসএমপির কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাত ১০ পুলিশ সদস্যকে আসামি করে মামলা দায়ের করে তার ভাই আবুল আহসান মোঃ আজরফ (জাবুর আহমদ)। তখন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার আজবাহার আলী শেখ ও কোতোয়ালী থানার ওসি মোঃ মঈন উদ্দিন শিপন মামলাটি আনুষ্ঠানিকভাবে রিসিভ করলেও এটিকে জিডি হিসেবে নথিভুক্ত করেন, মামলা হিসেবে গ্রহন করেননি। পরদিন তারা জানান, পুলিশের করা নাশকতার মামলার সঙ্গে সমন্বয় করে এ মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। যথাসময়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। পাশাপাশি গত ১৯ জুলাই নাশকতার ঘটনায় পুলিশ যে মামলা করে তার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করা হবে।
সাংবাদিক তুরাব নিহতের ২ দিন পর ঘটনার তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন এসএমপি কমিশনার জাকির হোসেন খান। সেদিন তিনি বলেছিলেন, কী কারণে এবং কীভাবে সাংবাদিক তুরাব নিহত হয়েছেন তার তদন্ত চলছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এরপরও তুরাবের উপর গুলীবর্ষণে নেতৃত্ব দানকারী এসএমপির উপ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ ও এডিসি উত্তর সাদেক কাউসার দস্তগীরের নেতৃত্বে প্রায় প্রতিদিনই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রজনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলীবর্ষণ করতে দেখা গেছে। এমনকি তাদের সামনেই আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য দিবালোকে বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছাত্রজনতার উপর হামলা করতে দেখা গেছে। কিন্তু ঐ কর্মকর্তাগণ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
পুলিশের মামলায় দায়সারা এফআইআর :
প্রকাশ্য দিবালোকে সাংবাদিক তুরাব হত্যাকান্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে এবং ভিন্নখাতে নিতে অত্যন্ত সুকৌশলে কোতোয়ালি থানায় একটি দায়সারা মামলা দায়ের করে পুলিশ। কোতোয়ালী থানার এসআই কল্লোল গোস্বামী বাদী হয়ে দায়েরকৃত হত্যা ও বিস্ফোরক বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলার (নং-৩২ (২০(৪)২৪) এজাহারে ৩৯ জনের নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত ২৫০০/৩০০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পুলিশের মামলার এফআইআরে উল্লেখ করা হয়- গত ১৯ জুলাই অনুমান রাত আটটায় ওসমানী মেডিকেল পুলিশ বক্সে কর্মরত এসআই খন্দকার জাফর ইমাম জানান- জনৈক আবু তাহের মো. তুরাব (৩৫) পিতা- মৃত আব্দুর রহিম, সাং- ফতেহপুর, থানা- বিয়ানীবাজার, জেলা- সিলেট, বর্তমানে- বাসা নং-১০ যতরপুর, থানা- কোতোয়ালী, জেলা- সিলেট- মৃতদেহ তার আত্মীয় স্বজনরা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এসআই খন্দকার জাফর ইমাম উক্ত হাসপাতালে উপস্থিত লোকজনদের নিকট হতে জানতে পারেন যে, ১৯ জুলাই অনুমান দুইটায় মৃত আবু তাহের মো. তুরাব (৩৫) মধুবন সুপার মার্কেটের সামনের সংঘর্ষে আহত হয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করে নিজ উদ্যোগে ইবনে সিনা হাসপাতালে চলে যান। পরবর্তীতে ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন ৬টা ৪৪ মিনিটের সময় মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর স্বজনরা তার মৃতদেহ এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে এসআই খন্দকার জাফর ইমাম মৃত তুরাবের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতের পর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করেন। আসামীগণ পুলিশের সরকারি কর্তব্য কাজে বাধা প্রদান এবং পুলিশ, সদস্যদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট করে সাধারণ জখম হত্যা, ক্ষতি সাধন, ভয়ভীতি প্রদর্শন সহ জীবন রক্ষায় ও সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করার জন্য বিস্ফোরক পদার্থ মওজুদ করে তা নিক্ষেপ এবং সরকারি যানবাহন ভাঙচুর করে পেনাল কোড আইনের- ১৮৬/৩৩২/৩৫৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০০ ৩০২/৪২৭/৫০৬ তৎসহ ১৯০৮ সনের দেয়ায় বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইনের ৪ এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৫(১) (ক) ধারার অপরাধ করে।
ঘটনার পরদিন ২০ জুলাই বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই কল্লোল গোস্বামী বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় এই মামলা দায়ের করেন। কিন্তু এই মামলার এজাহারের কোথাও সাংবাদিক তুরাবের শরীরে গুলির কথাটি উল্লেখ করেননি বাদী এসআই কল্লোল গোস্বামী। এর মাধ্যমে মামলার বিচারের ভবিষ্যতকে রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে বলে জানান একাধিক সিনিয়র আইনজীবী।
প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের গুলীতে নিহত সাংবাদিক তুরাব হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুলিশের এফআইআরে উল্টো ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের মামলার আসামী করা হয়েছে। মামলায় জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ হোসেন (৩৫), মহানগর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বি আহসান (২৮), জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দিনার (৩২), মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি শরীফ মাহমুদ (৩০) ও সেক্রেটারী শাহিন আহমদ (২৯), মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আফছর খানসহ (৪৫)সহ ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে আসামী করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয় আড়াই থেকে তিন হাজার জনকে।
ঘাতকরা কোথায়?
ঘটনার ২০ দিন পার হলেও গুলিবর্ষণকারী পুলিশ কর্মকর্তা সাদেক কাউছার দস্তগীর কিংবা অন্য কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ তুরাবের ঘাতকদের বিচারের দাবিতে সিলেটের প্রতিনিধিত্বশীল সাংবাদিকদের ৭টি সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলন ও জোর দাবী জানানো হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে এসএমপির উপ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ ও এডিসি উত্তর সাদেক কাউসার দস্তগীরের কোন খোঁজ মিলছেনা। যদিও তারা এখনো সেই পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার বন্ধ থাকায় তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
সাংবাদিক এটিএম তুরাবের ভাই আবুল আহসান মোঃ আজরফ জানান, সিলেটের ইতিহাসে এই প্রথম আমার ভাই তুরাব পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে আমি কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা দায়েরও করেছিলাম। অথচ পুলিশ সেটিকে মামলা না হিসেবে না নিয়ে জিডিমূলে তদন্ত করছে বলে সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এ ব্যাপারে কোন পুলিশ আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি। শেখ হাসিনা সরকারের পতন পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান সকল হত্যাকান্ডের বিচার হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমি প্রত্যাশা করি নতুন সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিবে। আমিও প্রয়োজনে আদালতের স্মরণাপন্ন হবো। আমার ভাই হত্যার বিচারের পাশাপাশি নিহত হওয়ার স্থানে শহীদ তুরাব স্মৃতিফলক স্থাপনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে জানতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জাকির হোসেন খানের মোবাইলে একাধিকবার কল দেয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তাই তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
নিহত সাংবাদিক আবু তাহের মোঃ তুরাব (এটিএম তুরাব) সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার পৌরসভার ফতেহপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা মরহুম মাস্টার আব্দুর রহীম ছিলেন বিয়ানীবাজার প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বিয়ানীবাজার পিএসজি স্কুলের শিক্ষক। তিন ভাই এবং এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তুরাব। আদরের ছোট সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার বৃদ্ধ মা। নিহত হওয়ার ৩ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এখনো সন্তানের কথা মনে করে ডুকরে কাঁদেন তিনি। তাকে অধিকাংশ সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলতে হচ্ছে।