আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছর: ব্যাংক লুটপাটের স্বর্ণকাল!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ আগস্ট ২০২৪, ৯:১৩:৪৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: অর্থনীতির লাইফলাইন বলা হয় ব্যাংক খাতকে। অথচ বিদায়ি শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এ খাতটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল লুটপাটের ক্ষেত্র হিসেবে। ঋণের নাম করে টাকা নিয়ে ব্যাংকগুলোকে বানানো হয়েছিল অর্থ লুটের কারখানা।
২০১১ সালে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার সেই হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি দিয়ে শুরু, আর থামাথামি নেই। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাত খেকে ঋণের নামে লুটপাট করা হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা।
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংক খাত থেকে অর্থ লোপাটের পরিমাণ আরও বেশি। কারণ গত ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ যে হারে বেড়েছে, অতীতে আর কখনো সেভাবে খেলাপি ঋণ বাড়তে দেখা যায়নি। যেমন ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যদিও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদায়ি শেখ হাসিনা সরকারের তিন মেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতে বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। একেকবারে ৩ হাজার, সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, আবার কখনো দেড়-দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে একেকটি ব্যাংক থেকে। আর এসব ঋণ নিয়েছেন সরকারের কাছের লোকেরা বা সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিরা। আসলে যেভাবে ব্যাংক খাত থেকে টাকা লোপাট হয়েছে সেটি অনেকটা দিনদুপুরে সবার চোখের সামনে দিয়ে চুরি করে নেওয়ার মতো। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, প্রকাশ্য দিবালোকে চুরির মতো করে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা লোপাট হলেও বিদায়ি সরকার ছিল নীরব দর্শক। গত ১৫ বছরে একটি ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা সরকার আমলে নিয়ে কঠোর শাস্তি দিয়েছে-এমনটি আমরা দেখিনি। আর একের পর এক এভাবে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি হলেও শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটেছে। এভাবে লুটপাটের কারণেই দেশের ব্যাংক খাত এখন ‘মুমূর্ষু রোগীতে’ পরিণত হয়েছে।
ঋণ কেলেঙ্কারির আলোচিত ঘটনাগুলো : গবেষণা সংস্থা সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ১৯টি ব্যাংকে ২৪টি বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এগুলো মধ্যে আলোচিক কয়েকটি লোপাটের ঘটনা হলো-
হলমার্ক কেলেঙ্কারি : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথম বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে। ওই বছর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালি ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপ ঋণের নামে হাতিয়ে নিয়েছিল ৪ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। হলমার্ক গ্রুপের এমডি তানভির আলমকে এই ঋণ নিয়ে দিতে সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির তদবির করেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি : ২০১১-১২ সালে বেসিক ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে প্রধান ভূমিকা রাখেন বেসিক ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু। এই টাকা থেকে ১১০ কোটি টাকা দিয়ে ঢাকায় সেনানিবাসে দেড় বিঘা জমির ওপর একটি বাড়ি কিনেছিলেন তিনি।
ইসলামী ব্যাংক : বেনামি কোম্পানির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এ বিষয়ে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ঋণ অনিয়মের অনুসন্ধানের জন্য উচ্চ আদালতে পিটিশন দাখিল করেন এক আইনজীবী। ইসলামী ব্যাংকে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে অপরিচিত ৯টি কোম্পানিকে নিয়ম লঙ্ঘন করে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার দেওয়া হয়। মিথ্যা তথ্যে রাজশাহীর নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিকে এই ঋণ দেওয়া হয়।
২০১৭ সালে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় জোরপূর্বক পরিবর্তন হয়। এ সময় দুই ব্যাংকের এমডিকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আর এসব পরিবর্তনে তড়িঘড়ি সম্মতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর থেকে ব্যাংক দুইটিতে বড় অনিয়ম শুরু হয়।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ : সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত ৩৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা ও বিতরণ করা ঋণ ছিল ৩১ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। কিন্তু ২০২১ সালভিত্তিক পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এসআইবিলের আরও ৫ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য। এতে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ২৩ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের আরেক বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। ২০১৬ সালে অজ্ঞাত পরিচয় হ্যাকাররা ভুয়া ট্রান্সফার ব্যবহার করে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ থেকে সুইফটের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার অর্থ হাতিয়ে নেয়। এর মধ্যে দুই কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলঙ্কা এবং ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপিন্সের জুয়ার আসরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ওই ঘটনাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক তহবিল চুরির একটি বলে ধরা হয়। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা অবহেলা অথবা ইচ্ছাকৃত যোগসাজশেই এ ভয়াবহ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে বলেও পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হয়।
এদিকে চুরির কয়েক বছর পার হলেও এখনও এই ঘটনায় ব্যাংকের ভেতরে কারা জড়িত তা বের করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। চুরি হওয়ার সেই ঘটনা সে সময় প্রায় এক মাস গোপন রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত এর দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হয় তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে। অর্থ চুরি নিয়ে সে সময় সরকারিভাবে একটি তদন্তও হয়। তবে সেই তদন্ত প্রতিবেদনটি পরে আর আলোর মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণ কেলেঙ্কারি : বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চাকতি ও আংটি, তা হয়ে আছে মিশ্র বা শংকর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট স্বর্ণ, হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ ভয়ংকর অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি স্বর্ণের পরীক্ষা করে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম ধরা পড়ে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে স্বর্ণের হেরফের হয়নি।
অন্যান্য ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি : এবি ব্যাংকে ১৬৫ কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে দুদক মামলা করেছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদার ২০২১ সালে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করেন। এ ঘটনায় দুদক ৩৭টি মামলা করেছে তার বিরুদ্ধে। এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২০১৬ সালে ৭০১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয় অনিয়মের মাধ্যমে। এ ছাড়া ভুয়া কোম্পানিকে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার ঋণ দেয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।