‘জুলাই গণহত্যা’ : নিহতের প্রকৃত সংখ্যা কত?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ আগস্ট ২০২৪, ৯:৪১:২২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : প্রথমে কোটা এবং তারপর সরকার পতনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া হত্যাকা-কে ‘জুলাই গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে সরকার। স্বয়ং আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এভাবেই এটির বর্ণনা দিয়েছে। তবে এ গণহত্যায় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা কত-তা নিয়ে প্রশ্নের পাহাড় জমেছে। কিন্তু উত্তর মিলছেনা কোথাও।
কয়েকদিন আগে সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন একটি ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আবার পরশু জাতিসংঘ বলেছে, জুলাই-আগস্টের ২২ দিনে অন্তত ৬৫০ জন নিহত হয়েছেন। আবার এ সময়ে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের একেকটি গণমাধ্যমে একেকরকম সংখ্যা তুলে ধরা হচ্ছে। তাই আন্দোলনে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিহতদের সংখ্যা জানার জন্য তালিকা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। একইসঙ্গে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্যেও নিহতদের তালিকা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও অস্থিরতা নিয়ে গত শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ১৬ জুলাই থেকে ১১ অগাস্ট পর্যন্ত সময়ে নিহত ৬৫০ জনের মধ্যে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪শ’র কাছাকাছি এবং বাকি প্রায় ২৫০ জন পরের দুইদিনে প্রাণ হারিয়েছেন। আর জুন থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে ৩২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
একইদিন ভারতের অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যম নর্থইস্ট নিউজকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, ঢাকার কিছু জায়গায় এবং অন্যান্য জেলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী মানুষকে অস্ত্রের আঘাতে বা গুলি করে, যাদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র ও তরুণ।
যা বলছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন :
নির্দিষ্ট কোনো তালিকা করা না হলেও সংঘাতে মৃতের সংখ্যা অন্তত এক থেকে দেড় হাজার হতে পারে বলে মনে করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা। তিনি বলেন, প্রথমেতো ভেবেছিলাম অন্তত ৫০০ হবে। কিন্তু হাসপাতালের ডাটা (উপাত্ত), মানুষের মুখের কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে এটা কোনোভাবেই এক থেকে দেড় হাজারের নিচে হবে না। বিশেষ করে যেদিন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলো, সেদিনও দুইশো/আড়াইশোর ওপর লাশ পড়েছে।
এই সমন্বয়ক বলছেন, নিহতদের অনেকের মৃত্যু ‘হার্ট এটাক, স্ট্রোক, সড়ক দুর্ঘটনা বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে, আবার অনেকের মর্গে থাকা লাশ কিংবা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়েছে। ফলে সারা দেশব্যাপী অনুসন্ধান করে তালিকা করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জন্য ‘অনেক বড় দায়িত্ব’। আর তাই ‘সরকারের লোক নিয়োগ করে শহীদদের তালিকা তৈরি করা জরুরি’ বলে মনে করেন তিনি।
ফাতেমা বলেন, আমরা আমাদের জায়গা থেকে বলছি যে সরকারিভাবে উদ্যোগটা নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে টিম গঠন করে শহীদদের সংখ্যাটা আইডেন্টিফাই (চিহ্নিত) করা খুব দরকার।
এদিকে হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী বিচার করা হবে বলে গণমাধ্যমে জানান আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তবে নিহতদের তালিকা করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কিছু বলা হয়নি।
প্রকৃত সংখ্যা কি জানা সম্ভব?
আন্দোলন চলাকালীন নিহত অনেকের তথ্যই হাসপাতালে নথিভুক্ত করা হয়নি। আবার ময়নাতদন্ত ছাড়াই অনেকের লাশ নিয়ে গেছেন স্বজনরা। থানাগুলোতেও নেই প্রকৃত মৃতের সংখ্যা।এমন প্রেক্ষাপটে কেবল নথিবদ্ধ তথ্যগুলোই প্রকাশিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যাওয়ার সুযোগ কম বলেই মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।
তিনি বলেন, প্রথম দিকে পাখির মতো মানুষ মেরেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে যে ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হতো সেগুলো অনেকটা ব্যবহার হয়েছে এবং সেই সময় এত বেশি মৃত ও আহতের সংখ্যা যে হাসপাতালগুলো সামাল দিতে পারছিলো না। অনেকক্ষেত্রে আত্মীয়রা লাশ নিয়ে চলে গেছে, আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছু লাশ গায়েব করেছে। অনেকে এখনো অজ্ঞাত আছে ।
এছাড়াও ঢাকায় ভাসমান জনগোষ্ঠী আছে। ফলে তাদের শনাক্ত করতে সময় লাগবে। ফলে প্রকাশিত কোনো সংখ্যাই হয়তোবা সঠিক না হতে পারে বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী। আর তাই এমন একটি ঘটনায় ‘অনুমাননির্ভর কথা না বলে কিছু সময় অপেক্ষা করে প্রকৃত সংখ্যা বের করার চেষ্টা করা উচিৎ’ বলেই মত তার।
নিহতদের তালিকা করা কেন জরুরি?
‘বিচারপ্রাপ্তি, ইতিহাসের প্রয়োজন এবং পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে’ নিহতদের তালিকা থাকা দরকার বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। অর্থাৎ মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার বিচার করতে চাইলে নিহতদের সম্পর্কে জানা জরুরি বলেই মনে করেন তিনি।
“দ্বিতীয়ত ইতিহাসের প্রয়োজনে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এত বড় নির্মমতা হয়ে গেল এখানে, কত মানুষকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হলো সেটি জানাটা আমাদের দরকার”, বলেন এই মানবাধিকারকর্মী। আর নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হলেও এই তালিকা লাগবে বলেও মত তার। সেক্ষেত্রে কাজ শুরুর পর এক থেকে দেড় মাসের মতো সময় লাগতে বলে ধারণা করেন লিটন।
নিহতদের মধ্যে ৬৭ শিশু-কিশোর :
নিহত শিশু-কিশোরদের মধ্যে ৫৭ জনের শরীরে গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। শিশু ও কিশোরদের মৃত্যু বড় ধাক্কা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতায় সারা দেশে কমপক্ষে ৬৭ শিশু–কিশোর নিহত হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ, অর্থাৎ ৫৭ জনের মরদেহে গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৯ কিশোরের। একজনের মৃত্যু সাউন্ড গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শিশু-কিশোরদের অনেকে বিক্ষোভে গিয়ে, অনেকে রাস্তা পার হওয়ার সময় নিহত হয়েছে। এমনকি বাসায় থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় (সাভার, টঙ্গীসহ) নিহত হয়েছে ৪০ জন। ঢাকার বাইরে ২৭ জন।