৮ জেলায় ৩০ লাখ মানুষ বন্যা আক্রান্ত : ঘরে ঘরে আর্তনাদ, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৫:১৬ অপরাহ্ন
ফেনী ও কুমিল্লার ৯৫ শতাংশ পানির নিচে * নিহত অন্তত: ৭ জন, নিখোঁজ অনেকে
জালালাবাদ রিপোর্ট: যেদিকে চোখ যাচ্ছে, শুধু পানি আর পানি। গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ পানিতে ডুবে আছে। কোথাও বুকপানি, কোথাও গলা অবধি। একতলা ঘর তলিয়ে গেছে। ফসলি জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট সবকিছুই ডুবে আছে। কেউ কেউ কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ বুকপানিতে সাঁতরে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। আর কেউ কেউ পানির তীব্রতার কাছে হার মেনে উদ্ধারের জন্য আর্তনাদ করছেন।
এই চিত্রগুলো দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও নোয়াখালী জেলার। জেলাগুলো ভারতের ত্রিপুরা সংলগ্ন। এই পাঁচ জেলার ভয়াবহতা গত ৪০ বছরেও ঘটেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে ফেনী জেলার ৯৫ শতাংশ এলাকাই পানির নিচে। এলাকার ঘরে ঘরে অসহায় মানুষের আর্তনাদ। কোথাও কোন ঠাঁই নেই। এক টুকরো শুকনো এলাাকার সন্ধানে নারী, পুরুষ, শিশুসহ অন্য প্রাণীকূলগুলোরও। জীবন বাঁচানোর এক যুদ্ধ যেন তাদের। ভারতীয় ঢলের পানি ও ¯্রােতের কাছে জীবন বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টায় তারা।
বন্যার তীব্রতায় শুধু কুমিল্লায় প্রাণ গেছে ৪ জনের। বুধবার কুমিল্লা নগর, লাকসাম, চৌদ্দগ্রাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলায় এ ঘটনা ঘটে। বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে মারা গেছেন কক্সবাজারের রামুতে শিশুসহ ২ জন। আর নিখোঁজ রয়েছেন আরও ২ জন। আর ফেনীতে প্রাণ হারিয়েছেন ১ জন। আর অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। শত শত গরু, মহিষ, ছাগল, হাস-মুরগীও ভেসে গেছে পানির স্রোতে। মারা গেছে অজস্র।
এত তীব্্র না হলেও এমন অভিন্ন চিত্র উত্তর-মধ্যাঞ্চলের সিলেটের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও।
ফেনীর জগলুল ইসলামের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। ইতিহাস টেনে তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালের দিকে ফেনীতে আরেকবার বন্যা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বাড়ি ডোবেনি। এবারের মতো পানি তিনি আর দেখেননি।
জগলুলের বাড়ি ফেনী সদরের কালীদহ ইউনিয়নের হাফেজিয়া মাদ্রাসা এলাকায়। বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, এত বড় বন্যা হবে, তা কখনো ভাবিনি।
আবু ইউসুফের বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। বুধবার রাতে প্রবল স্রোতে পানি এসে আছড়ে পড়ে তাঁর বসতভিটায়। এরপর পানির উচ্চতা শুধুই বেড়েছে। চোখের পলকে ঘরে চাল ছুঁয়ে যায় পানি। তিনি বলেন, এতো পানি এই জীবনে তিনি দেখেননি ফেনীতে। তিনি বলেন, ভারত বাঁধ খুলে দেয়ায় আজ বিপন্ন মানুষের জীবন।
ওদিকে, বাঁধ খুলে দেওয়ার মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথে অসহযোগিতা করছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।
এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার বিকেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা। বৈঠকে চলমান বন্যা পরিস্থিতি এবং এর নানান দিক ও করণীয় নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানা গেছে।
৮ জেলায় আক্রান্ত ৩০ লাখ মানুষ :
বৃহস্পতিবার দুপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, বন্যার কারণে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। তলিয়ে গেছে ৩৫৭টি ইউনিয়ন। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার।
এ সময় জানানো হয়, সেনাবাহিনী থেকে ১৬০ জন সদস্য ও ৪০টি উদ্ধারকারী যান ফেনীতে পাঠানো হয়েছে। একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। নৌবাহিনীর ৭১ জন সদস্য ও আটটি উদ্ধারকারী যানও দুর্গত এলাকাগুলোতে কাজ করছে। সেইসাথে, বিজিবিসহ অন্যান্যরা নৌযান নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এছাড়া বন্যার্তদের সহায়তার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়েও কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে, যার নম্বর হলো- ০১৩১৮২৩৪৫৬০।
কয়েকদিন বৃষ্টিপাত চলতে পারে : আবহাওয়া অধিদপ্তর
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বৃহস্পতিবারও সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বৃষ্টিপাত অব্যহত থাকতে পারে দেশের কিছু কিছু জেলায়। ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অনেক জায়গায়ও একই ধরনের বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে কোনও কোনও স্থানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বৃষ্টিপাতের এ প্রবণতা আজ শুক্রবার ও কাল শনিবারও অব্যাহত থাকবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেন, বন্যা বা জলাবদ্ধতা যা-ই হোক, তা নির্ভর করে উজানে কতটুকু বৃষ্টি হচ্ছে তার ওপর। কয়েক দিন ধরে দেখছি উজানে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে বৃষ্টিপাত, বন্যা পরিস্থিতিতে তার ৮ থেকে ১০ শতাংশ অবদান থাকে। উজানের ভারী বৃষ্টির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টির কারণে আমাদের দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগামী দু–এক দিন উজানে ভারী বর্ষণ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফেনী বা কুমিল্লা অঞ্চলে ভারী বর্ষণের প্রবণতা আগামীকাল বিকেল থেকে কমে আসতে পারে।