বিপদসীমা ছাড়িয়েছে কুশিয়ারা, মনু ও খোয়াই : ঝুঁকিতে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ শহর, নির্ঘুম রাত
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ আগস্ট ২০২৪, ৯:৫৬:৪২ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: সিলেটে বৃষ্টিপাত ও ভারতীয় ঢলে বিপদসীমা ছাড়িয়েছে কুশিয়ারা নদী। এতে কুশিয়ারা অববাহিকা এলাকাগুলো তলিয়ে যাচ্ছে। তবে সুরমার কোন পয়েন্ট বিপদসীমা না ছাড়ালেও দ্রুত বাড়ছে পানি। বৃষ্টি ও ঢল অব্যাহত থাকলে সুরমাও বিপদসীমা ছাড়াতে পারে। এছাড়া মৌলভীবাজারের মনু, ধলাই এবং হবিগঞ্জের খোয়াই নদের পানি বিপদসীমা ছাড়িয়েছে। এতে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ দুই জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ঝুঁকিতে পড়েছে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার শহর।
বৃহস্পতিবার সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, সিলেট জেলায় কুশিয়ারার চারটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইসঙ্গে সিলেটের অন্যতম প্রধান নদী সুরমার পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। সুরমার পানিও বিপদসীমার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবো জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময় কুশিয়ারার শেওলা পয়েন্টে বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৭৩ সেন্টিমিটার ও শেরপুর পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আগের দিনও এই নদীর তিনটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপরে ছিল।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের সঙ্গে সিলেটে বৃষ্টিপাতও অব্যাহত রয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ৪৮ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ দশমিক ৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল মুঈদ বলেন, বৃষ্টিপাত আরও দুইদিন অব্যাহত থাকতে পারে। এরপর আবহাওয়া স্বাভাবিক হতে পারে।
হবিগঞ্জে খোয়াই বিপদসীমার ২৭৯ সেন্টিমিটার ওপরে :
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের খোয়াই নদের পানি বিপদসীমার ২৭৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত এ পরিস্থিতি ছিল। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে শহর রক্ষা বাঁধ।খোয়াই নদের শহর রক্ষা বাঁধ উপচে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকছে। বালুর বস্তা দিয়ে পানি ঠেকানোর চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
হবিগঞ্জ পাউবো সূত্রে জানা গেছে, টানা ২ দিনের বৃষ্টি ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে খোয়াই নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। খোয়াই নদের উৎপত্তি স্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আটারোমুড়ায়। নদটি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে।
বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার দিকে খোয়াই নদের চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা সীমান্তে বিপদসীমার ২৭৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। পাশাপাশি হবিগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধের মাছুলিয়া এলাকায় ১৮৫ সেন্টিমিটার, শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় ১৭০ সেন্টিমিটার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া শহর রক্ষা বাঁধের তেঘরিয়া, গোপায়া ও তেতৈয়া এলাকায় বাঁধ উপচে পানি শহরে ঢুকছে। গোপায়া এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ মিয়া বলেন, পানি বেড়েই চলেছে। পানি বাড়া অব্যাহত থাকলে হবিগঞ্জ শহর ডোবার আশঙ্কা আছে। গত রাত থেকে গ্রামবাসী রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে।
হবিগঞ্জ শহর লাগোয়া জালালাবাদ এলাকায় নদের পুরোনো ভাঙন দিয়ে পানি ঢুকে নোয়াগাঁও গ্রামসহ আশপাশে কয়েকটি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি এই পানি জালালাবাদ হয়ে হাওরে ঢুকছে।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাবিবুর রেজা জানান, খোয়াই নদের পানি বাড়ার কারণ হচ্ছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল। এ ঢল অব্যাহত থাকলে শহর ঝুঁকিতে পড়বে।
মৌলভীবাজারের লোকালয়ে ঢুকছে মনু নদের পানি :
মৌলভীবাজারের রাজনগরে মনু নদ প্রকল্প বাঁধের একাধিক স্থান ভেঙে গেছে। অনেক স্থানে বাঁধ উপচে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার লোকালয়ে ঢুকছে মনু নদের পানি। ফসলের মাঠ ডুবছে। বাড়িঘরে পানি উঠছে। মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের একাধিক স্থান পানিতে তলিয়ে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজনগর উপজেলার মুনসুরনগর ইউনিয়নের কদমহাটা এলাকায় পানি উপচে মনু নদ প্রকল্পের বাঁধের একটি স্থান ভেঙে যায়। একই এলাকায় পাশাপাশি আরও তিনটি স্থান দিয়ে পানি উপচে বের হচ্ছে।
অন্যদিকে মনু নদে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মৌলভীবাজার শহরের মানুষ বুধবার রাতটি বন্যার আতঙ্কে নির্ঘুম কাটিয়েছেন।প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, বুধবার রাতে রাজনগর উপজেলার শ্বাসমহল এলাকায় মনু সেকেন্ডারি বাঁধ (নদসংলগ্ন বাঁধ) ভেঙে সেকেন্ডারি বাঁধ ও মনু নদ প্রকল্প বাঁধের মধ্যবর্তী গ্রামের লোকালয়ে পানি ঢোকে। রাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সব ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। এ সময় যে যা পেরেছেন, সঙ্গে নিয়ে ঘর ছেড়েছেন। অনেকেই কদমহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কদমহাটা উচ্চবিদ্যালয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেছেন।
এদিকে সকালের দিকে কদমহাটায় বাঁধের একটি স্থান ভেঙে গেছে। এতে রাজনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই পানি গিয়ে নামছে কাউয়াদিঘি হাওরে। কাউয়াদিঘি হাওরপারের সব কটি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
সকাল সাতটার দিকে কদমহাটা গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকেই কদমহাটা বাজারের পূর্ব দিকে মনু প্রকল্প বাঁধের অন্তত চারটি স্থান দিয়ে পানি উপচে বের হচ্ছে। দ্রুতগতিতে পানি নামছে। বাঁধের অংশ টুকরা টুকরা হয়ে ধসে পড়ছে। বন্যার আতঙ্কে পানির কাছে ছুটে আসছেন অনেক মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, রাতে স্থানীয় লোকজন বালুর বস্তা ফেলে পানি উপচানো বন্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনু নদের পানি দ্রুত বাড়ায় তাঁদের সব চেষ্টা ভেস্তে গেছে। সকাল থেকে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। একপর্যায়ে তাঁরা হাল ছেড়ে দেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কদমহাটা বাজারসংলগ্ন পূর্ব দিকে বাঁধের একটি স্থান ভেঙে যায়। এতে হু হু করে পানি ঢুকতে থাকে গ্রামের দিকে। অল্প সময়ের মধ্যে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের কদমহাটা এলাকা কয়েক ফুট পানিতে তলিয়ে যায়।
মনু নদে পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় মৌলভীবাজার শহরবাসীর মধ্যে বন্যা-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল চুইয়ে শহরের এম সাইফুর রহমান সড়কের পশ্চিম বাজারের দিকে পানি ঢুকতে থাকে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাটির বস্তা ফেলে স্বেচ্ছাশ্রমে শহর প্রতিরক্ষা দেয়াল চুইয়ে শহরের দিকে পানির প্রবেশ বন্ধ করেন। সারা রাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে যাঁর মতো একে অন্যকে সতর্ক করেছেন। বন্যা-আতঙ্কে শহরের মানুষ অনেকটাই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন।