১১ জেলায় অর্ধকোটি বানভাসী মানবিক বিপর্যয়, ১৩ মৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১০:৩০:১৬ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: ঢাকায় থাকেন ক্লোজআপ তারকা পুতুল। বাবা-মায়ের বাড়ি ফেনী শহরে। গত কয়েক দিনে ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে পুতুলদের ফেনী শহরের উকিলপাড়ার বাড়ির দোতলা পর্যন্ত পানি উঠেছে। এই বাড়িতে পুতুলের ভাই তাঁর পরিবার নিয়ে থাকতেন। পাশে বড় বোনও থাকতেন। গত দুদিনে বন্যার পানি বেড়ে যাওয়াতে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হয়েছে।
পুতুল বলেন, আমার এলাকাসহ বন্যাকবলিত সব এলাকার কী যে ভয়াবহ অবস্থা, ভাবলেই গা শিউরে ওঠে! একটাই কথা, আল্লাহ আমাদের রক্ষা করো। শুধু পুতুলদের বাড়ি নয়, গোটা ফেনী জেলার চিত্র-ই এখন এটি। ফেসবুক পোস্টে অনেকে লিখছেন, ‘আহা! আমাদের ফেনী পানির তলায়।
ফেনী ছাড়াও কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ির অবস্থাও ভয়াবহ। এসব জেলার এমনও এলাকা আছে যেখান থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধারে হেলিকপ্টারেরও প্রয়োজন পড়ছে। এলাকা হতে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা পানিবন্দীদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও র্যাবের হেলিকপ্টারসহ বেসরকারী হেলিকপ্টারও ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে।
জেলাগুলোর দূর্গম এলাকাগুলোতে অসংখ্য লোক আটকা পড়েছেন বলে জানা গেছে। অনেকে অসহায় আকুতি জানিয়েছেন তাদের উদ্ধারে। এলাকাগুলোতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। একটু আশ্রয়ের জন্য একটু শুকনো জায়গাও পাওয়া যাচ্ছেনা। বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসার অভাবে মানবেতর সময় পার করছেন বানভাসীরা। বন্যার্ত মানুষ নানাবিধ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।এদিকে, শুক্রবার দুপুর ১২টার পর সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে দেশে ১১টি জেলা বন্যাকবলিত। এই জেলাগুলোয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৯টি পরিবার পানিবন্দী। আর এই বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছেন।
এসময় জানানো হয়, বন্যাক্রান্ত জেলাগুলো হলো-ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। বন্যায় এখন পর্যন্ত কুমিল্লায় ৪ জন, কক্সবাজারে ৩, চট্টগ্রামে ২, ফেনীতে ১, নোয়াখালীতে ১, লক্ষ্মীপুরে ১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন মারা গেছেন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসের তথ্য উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান বলেন, বন্যা পরিস্থিতি ধীরগতিতে উন্নতি হচ্ছে। তিনি জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ মানুষ। বন্যাকবলিত এলাকায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশের সদস্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক দল উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টা এবং সচিবরা বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বন্যা উপদ্রুত এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপদ্রুত এলাকায় অবস্থান করছেন বলেও জানানো হয়।
উদ্ভূত বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সহায়তার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহায়তা সমন্বয় সেল’ গঠন করা হয়েছে। শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।তবে আশার কথা হচ্ছে শুক্রবার সকাল থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে না। কোথাও কোথাও রোদ দেখা গেছে। আবার কোথাও গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে।
পানি নামছে ধীরে :
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানি ধীরগতিতে কমছে। শেষ ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বৃষ্টিপাত হয়নি। আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও ভারী বৃষ্টিপাতের আভাস নেই। ফলে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।শুক্রবার দুপুরে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, বিগত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বৃষ্টি হয়নি। ফলে উজানে নদ-নদীর পানি কমছে।বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায়ও দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাতের আভাস নেই। ফলে দেশে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, ধলাই ও খোয়াই নদীর পার্শ্ববর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। একই সঙ্গে ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, গোমতী ও হালদা নদীর পার্শ্ববর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
ফেনীর ৯২ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার অচল :
বন্যাকবলিত ফেনী জেলায় ৯২ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার অচল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ-সংযোগ না থাকা এবং টাওয়ার এলাকা ডুবে যাওয়ায় নেটওয়ার্ক সচল করা যাচ্ছে না। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অন্য ১০ জেলার প্রায় ১১ শতাংশ টাওয়ার অচল হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত বন্যাকবলিত অঞ্চলের মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্যে এ কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বিটিআরসি জানিয়েছে, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ১৩ হাজার ২৪০টি টাওয়ারের মধ্যে শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ১ হাজার ৪৬১টি টাওয়ার অচল ছিল। এর মধ্যে ফেনী জেলার ৯১ দশমিক ৯ শতাংশ টাওয়ারই অচল হয়ে গেছে। এরপর নোয়াখালী জেলার ২১ শতাংশের বেশি, খাগড়াছড়ির ১৫ শতাংশের বেশি ও কুমিল্লার প্রায় ১৪ শতাংশ টাওয়ার অচল।
সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় টাওয়ার সচল করতে সমন্বয়ের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। তবে যেসব টাওয়ার এলাকা ডুবে গেছে, পানি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত সচল করার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। ফেনী জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত টাওয়ার সচল করা কাজ চ্যালেঞ্জিং ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। এছাড়া সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় এখানে যোগাযোগ স্থাপন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করেছে বিটিআরসি।