শাবিতে আল্টিমেটামের পর ছাত্রলীগ নেতাদের হল ত্যাগ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ৯:৫৩:১৯ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: জনরোষে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেশব্যাপী গা ঢাকা দিলেও সিলেটের সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় হয় ছাত্রলীগের ‘বি’ টিম। ইতোপুর্বে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় অনেক অপকর্মের অভিযোগ থাকা সত্বেও তারা অনৈতিকভাবে হল দখলের নানা চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত এলাকাবাসী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের আল্টিমেটামের মুখে হল ত্যাগ করেছেন তারা। সোমবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে তারা হল ছেড়ে চলে যান বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগের দোসর রয়েছে এমন অভিযোগ তুলে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে আবাসিক হল ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছিল স্থানীয় জনগণ। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে আবাসিক হলগুলো ছেড়ে চলে গেছেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার (২৬ আগস্ট) বেলা আড়াইটার দিকে স্থানীয় লোকজন মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলের সামনে অবস্থান নেন। তারা ছাত্রলীগ বিরোধী মিছিল দিতে থাকেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ছাত্রলীগ ও তাদের দোসররা খুন, গুম হত্যার সাথে লিপ্ত ছিল। ছাত্রলীগের একটা চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এখনো তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের দাবি, হল খালি হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়ম অনুযায়ী যাদেরকে সিট বরাদ্দ দেবে তারাই কেবল হলে অবস্থান করবে। কিন্তু এখন আমরা ছাত্রলীগের কোন এজেন্টকে হলে দেখতে চাইনা।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. সাজেদুল করিম বলেন, আমরা হলের বিশৃঙ্খল একটা পরিস্থিতির কথা জানতে পেরে এখানে এসে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলি। শিক্ষার্থীরা আমাকে বলেন যেহেতু পরিস্থিতি এখন ভালো না তাই আমরা পিসফুলি এক্সিট করতে চাই। আমি সমন্বয়কদের সাথেও কথা বলেছি। সবদিক বিবেচনা করে এখন হল ত্যাগ করাই শ্রেয় বলে মনে করছি।
তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসন আসলে যেভাবে ভালো হয় সেভাবেই শিক্ষার্থীদেরকে হলে উঠানো হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রলীগ নামে হল ছাড়লেও তাদের কতিপয় দোসরদের রেখে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের ছত্র ছায়ায় ক্যাম্পাস আধিপত্য বিস্তার ও হলের সিট দখলসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। গত কয়েকদিন থেকে এর অনেক প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শিক্ষার্থীরা শেয়ার করছে। এছাড়া ছাত্রলীগের মিটিং মিছিলে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তাদের মধ্যে গুটিকয়েক কোটা বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অনেকেই সংহতি প্রকাশ করেনি। শেষ পর্যন্ত তারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল গুলোতে আধিপত্য ধরে রাখতে সাধারণ ছাত্র পরিচয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা সময়ে মিটিং করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে।
সূত্র মতে, বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিতাড়িত ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাদের মদদেই ছাত্রলীগের ’বি’ টিমের নেতারা ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্র পরিচয়ে আবারো মাথাচারা দিয়ে উঠতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এ বিষয়ে আন্দোলনকারী একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, যারা বর্তমানে আবাসিক হলের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছে। তারাই একটা সময় ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় নানা অপকর্ম করেছে। তারা এখন নিজেদের সাধারণ ছাত্র পরিচয়ে হলে সংবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদেরকে যদি সাধারণ ছাত্ররা প্রতিহত না করে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আবারো ফ্যাসিস্টের দোসররা মাথা ছাড়া দিয়ে উঠবে। এতে করে আবারো বিশ্ববিদ্যালয় নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন তারা।
এমন পরিস্থিতিতে স্বোচ্চার হন স্থানীয় এলাকাবাসী। হল থেকে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বিতাড়িত করার দাবীতে সচেতন এলাকাবাসীর উদ্যোগে রোববার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংশিষ্ট এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শত শত বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বিক্ষোভ মিছিলটি স্থানীয় নতুন বাজার এলাকা থেকে শুরু হয়ে হল এলাকা প্রদক্ষিণ করে নতুন রাজারে সমাবেশের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।
সভায় বক্তার বলেন, লাখো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে একটি সফল গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিজয় অর্জিত হলেও শাবিপ্রবিতে এখনো স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাদের আস্ফালন এখনো বন্ধ হয়নি। আমরা বিশ্বস্থ সূত্রে জানতে পেরেছি, শাবিপ্রবির ছাত্র হল গুলোতে এখনো অনেক চিহ্নিত ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা অস্ত্রসহ অবস্থান করছে, যারা ইতোপূর্বে ছাত্রহলগুলোতে অস্ত্র ও মাদকের সয়লাব ঘটিয়ে সন্ত্রাসী অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল। এসব চিহ্নিত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী পার এলাকায় চাঁদাবাজী, বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটের হোটেল রেস্তোরায় ফাও খাওয়া সহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ মূলক কর্মকান্ড সংঘটিত করেছিল। এছাড়া কতিপয় ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী একটি সিন্ডিকেট বানিতে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ্ববর্তী এলাকার যুব সমাদের মাঝে মাদকের অবাধ বিস্তার করেছিল।
ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের পর একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মানের জন্য এখন দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে শাবিপ্রবির ক্যাম্পাসে এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের অবস্থান এলাকার শান্তিপূর্ণ অবস্থা ও বিপ্লবের চেতনার প্রতিবন্ধক হিসেবে আমরা মনে করি। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ও যথাযথ কতৃপক্ষের কাছে কার্যকরী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিষয়টির উপযুক্ত প্রতিকার কামনা করছি।
উক্ত প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন অত্র এলাকার বার বার নির্বাচিত মেম্বার তারেক মিয়া বাবুল পরিচালনা করেন যুবনেতা আব্দুল মাজীদ। বক্তব্য রাখেন ৩৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রিয়াজ মিয়া, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ি আতিকুর রহমান, সালিশ ব্যক্তিত্ব আব্দুল মালিক মানিক, ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার কাওছার আহমদ, সালিশ ব্যক্তিত্ব ফয়জুল হক, ফেরদৌস আহমদ, যুবনেতা মকবুল হোসেন, সমাজসেবী বেলাল আহমদ, ফয়সল আহমদ, ছাত্রনেতা মাঈনুল ইসলাম, এনামুল হক, ফয়জুল আলম, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল জব্বার,শামীম আহমদ, জয়নাল, আলা উদ্দিন, ওয়ারিছ আলী, হারুন, জাফর, মোতাহির আলী, বেলাল, দেলওয়ার, শিপার, মিজান, মো: হোসেন, মুহিত, নাসির, সাদেক, শহিদ, রেজন, আবুল কালাম ও সুবেল আহমদ প্রমুখ।
এদিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ছাত্রলীগ মুক্ত নয় বলে মন্তব্য করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও প্রধান সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব। সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত মঞ্চে এক উন্মুক্ত আলোচনা সভায় এই মন্তব্য করেন গালিব।
হলের বিভিন্ন সমস্যা নিরসনে বৈষম্যবিরোধী সমন্বয়ক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনে আয়োজিত এই আলোচনায় গালিবের এই মন্তব্য বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে। সারাদেশের সব জায়গায় ছাত্রলীগ পালিয়ে গেলেও শাবিপ্রবির হলগুলোতে ছাত্রলীগের এই অবস্থান নিয়ে শংকিত পাশ্ববর্তী এলাকাবাসীও। অতীতে হলগুলোতে অবস্থান করে ছাত্রলীগের সীমাহীন চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ছিলেন এলাকাবাসী।
শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সাস্টের হলে ছাত্রলীগের কয়েকশো কর্মীরা পূর্বের ন্যায় অবস্থান বজায় রেখেছিল। হাইলাইটেড ছাত্রলীগ নেতারা পালিয়ে গেলেও ছোট্ট কর্মীরা কোনোভাবেই হল ছাড়ছিলনা। সাধারণ শিক্ষার্থী সেজে হল দখলে রেখেছিলো এবং পলাতক নেতাদের ইশারায় ক্যাম্পাসে অবস্থান শক্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলো। লবিং করে ছাত্রলীগ নেতাদের মদদে এরা হলে উঠেছিল। নেতাদের সকল অপকর্ম, ত্রাস এর শক্তি হিসেবে কাজ করছিলো এই সাধারণ শিক্ষার্থী নামধারী ছাত্রলীগ সমর্থকেরা। সমন্বয়ক টিম কর্তৃক নতুনভাবে মেধার ভিত্তিতে হলে সিট বণ্টনের কথা বলা হলে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে মেধাহীন এই লীগ সমর্থকদের। তারা সমন্বয়কদের বয়কট করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্যাম্পাসে। তাই সমন্বয়কদের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং এলাকাবাসী মিলে স্বৈরাচার হাসিনার দোসরদের হল ছাড়া করে সাস্ট ক্যাম্পাস মুক্ত করে।
হল ত্যাগ করা একাধিক শিক্ষার্থী জানান, এই মুহূর্তে শিক্ষার্থীরা কোথায় গিয়ে থাকবে। অনেকের টিউশনি আছে তাদের টিউশন গুলার কী হবে। এছাড়া সন্ধ্যার পর অনেক দূর দূরান্তের শিক্ষার্থীরা কোথায় যাবে। বন্যা কবলিত এলাকার শিক্ষার্থীরা যেমন, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনি, মৌলভীবাজার ওনারা কী করবে। মাস শেষ, অনেকের কাছে একবেলা বাহিরে খাওয়ার মতো টাকা নাই, কোনো জায়গায় থাকা তো দূরের কথা। সবথেকে কষ্টের কথা হলো এই বুকবরা হতাশা নিয়ে এখনো গেইটে বসে আছে অনেকেই।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শাবির প্রধান সমন্বয়ক আসাদুল্লাহ আল গালিব দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, স্থানীয় এলাকাবাসী, প্রকৃত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উপস্থিতিতে হলে থাকা শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করেছেন। বর্তমানে হল খালি রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসিসহ নতুন প্রশাসন নিয়োগ হলে মেধার ভিত্তিতে সীট বন্টন করা হবে।
এ ব্যাপারে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. সাজেদুল করিম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয় অভিভাবকশুন্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় এলাকাবাসীর অভিযোগ তারা ছাত্রলীগ। সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে হল ত্যাগের আল্টিমেটাম দেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে আমরা হলে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে অনেকেই তাদের আর্থিক সংকট নানা সমস্যার কথা বলে হলে থাকার সুযোগ চেয়েছেন। আমরা বলেছি আর্থিক বিষয়টি আমরা দেখবো। এরপরও হল ত্যাগ করাই ভালো। শেষ পর্যন্ত হলের সকল শিক্ষার্থীরা হল ছেড়েছে। হলটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।