বন্যার আগ্রাসী রূপ, নানা বিশ্লেষণ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ আগস্ট ২০২৪, ৩:৩০:৪০ অপরাহ্ন
মৃত্যু বেড়ে ২৩, ক্ষতিগ্রস্ত ৫৭ লাখ * এ জন্মে এমন বন্যা আর দেখিনি : প্রবীণ এক কবি’র উক্তি
জালালাবাদ রিপোর্ট: কোথাও কোথাও বাড়ির এক তলা পেরিয়ে দোতলা ছুঁয়েছে বানের পানি। শহর-গ্রাম পুরো জনপদই পানিতে একাকার। এমন চিত্র ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, লক্ষীপুরে। আরো ছয় জেলার চিত্রও কম-বেশী এমন।
এবারের বন্যা একদিকে যেমন আকস্মিক অন্যদিকে অকল্পনীয়। ফেনী, কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি, লক্ষীপুর, নোয়াখালীতে বন্যা রীতিমতো আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। এমন বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে এই জেলাগুলোর বাসিন্দারা বলছেন, সেখানে ‘সচরাচর বন্যা হয় না’।
প্রবীণ কবি ও সাহিত্যিক মু. ইকবাল চৌধুরী বলেন, এ জন্মে এমন বন্যা আর দেখিনি। বাপ-দাদাদের কাছ থেকেও এমন বন্যার কথা শুনিনি। শুধু এ কবি নন, অসংখ্য প্রবীণের বক্তব্যও এক ও অভিন্ন।তবে সিলেটসহ হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারে প্রায়ই বন্যা দেখা যায়। বিশেষ করে ২০২২ সালে সিলেটের বন্যা সবাইকে নাড়া দিয়ে যায়। কিন্তু ফেনী, কুমিল্লায় এমন বন্যা তো দেখাই যায়না। এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
এবার কেন বন্যা হলো?
জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলছেন, সারা মাসে যে পরিমাণ বৃষ্টি হবার কথা, অগাস্ট মাসের মাঝের তিনদিনে তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।এছাড়াও ত্রিপুরা মিজোরামসহ বাংলাদেশের ওই অঞ্চলে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা যদি ঢাকায় হতো, তাহলে ঢাকার ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে যেত বলেও মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক। ফলে বন্যার জন্য অতিবৃষ্টির বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন এই বিশ্লেষক।
কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামে ‘বন্যা একেবারে হয় না, তাও না’। তবে অন্য বছরগুলোর তুলনায় এবছর বন্যা বেশি হয়েছে বলে জানান বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লাতে অত বড় বন্যা হয় নাই। কিন্তু ফেনী, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারে সাধারণত বন্যা হয়। এ বছর বড় পরিসরে বেশি এলাকাজুড়ে বন্যা হয়েছে, ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।২০০৭ সালের পর কুমিল্লায় এবারই বড় আকারের বন্যা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে ২০১৮ সালেও এমন বন্যা দেখা যায়। এদিকে, এই দুর্যোগকে অস্বাভাবিক মনে করছেন না জল পরিবেশ ইন্সটিউটের চেয়ারম্যান ম. ইনামুল হক।
বরং আগের থেকেই ফেনী বন্যাপ্রবণ এলাকা বলে জানান তিনি। আর মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া, এই তিনটি নদী জেলাটিকে বেষ্টিত করে রেখেছে। তিনি বলেন, “নদীর পাশে বন্যা প্রতিরোধ বাধ আছে। এই বাধ অল্প বন্যা প্রতিরোধ করতে পারে, বড় বন্যা নয়। ফলে মিজোরাম ও ত্রিপুরায় যে ভারি বর্ষণ হয়েছে, তা উজান থেকে ভাটিতে নেমে এসেছে। আর এর মধ্যে একটি প্রভাব রেখেছ স্থানিক নি¤œচাপ। কারণ স্থানিক নি¤œচাপ হলে মেঘ উত্তর দিকে সরে যেতে পারে না। ফলে একটি জায়গাতে বৃষ্টিপাত করতেই থাকে।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অভিযোগ করে বলেছেন, পানি ছাড়ার আগে বাংলাদেশকে জানানোর বিষয়টি ভারত প্রতিপালন করেনি। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
বন্যার উচ্চ ঝুঁকি :
বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গত বছর অগাস্টে গ্রান্থাম রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড দ্য এনভায়রমেন্ট ও সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স এন্ড পলিসি থেকে একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়।এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়াও ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সাল অর্থাৎ ৪৩ বছরে হওয়া ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আর এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, কেবল ২০১৪ সালের বন্যায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ।
২০২২ সালের বন্যায় সাত দশমিক তিন মিলিয়ন মানুষ এবং এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ২৩, ক্ষতিগ্রস্ত ৫৭ লাখ :
গতকাল সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলমান বন্যায় ১১ জেলায় মোট ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৮টি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৭ লাখ এক হাজার ২০৪ জন।মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান বন্যায় এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে ২৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিখোঁজ রয়েছেন দুইজন।এই ২৩ জনের মধ্যে কুমিল্লায় ৬ জন, ফেনীতে ১ জন, চট্টগ্রামে ৫ জন, খাগড়ছড়িতে ১ জন, নোয়াখালীতে ৫ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন ও কক্সবাজারে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলো হলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার।
পানিবন্দি-ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মোট তিন হাজার ৮৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট চার লাখ ৬৯ হাজার ৫২৩ জন মানুষ এবং ২৮ হাজার ৯০৭টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।এদিকে নজিরবিহীন রেকর্ড এ বন্যায় চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে জনজীবনে। নেই বিশুদ্ধ খাবার পানি, নেই খাদ্য ও ওষুধ, নেই বিদ্যুৎ। আসলে মানুষের জীবনে যা প্রয়োজন কিছুই নেই এসব এলাকায়। তাই এসব এলাকার মানুষের মাঝে কেবলই হাহাকার ও আর্র্তনাদ।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি উদ্যোগ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা চলমান থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আবার অনেক জায়গায় খাদ্য সহায়তা পৌঁছানোও যাচ্ছে না। ফলে বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত আছে। শেষ ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাগুলোতে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত আছে। ফলে বর্তমানে ফেনী ও কুমিল্লা জেলার নি¤œাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির ধীরগতিতে উন্নতি অব্যাহত আছে।
এদিকে, সিলেটের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার নদীগুলোতে পানি সমতল বিপদসীমার নিচে নেমে এসেছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে।
তবে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিদসীমার উপরে অবস্থান করছিলো। ফলে সিলেটের কুশিয়ারা অববাহিকার এলাকাগুলো এখনো ডুবে আছে।