জুলাই বিপ্লব, এমসি কলেজের ভূমিকা
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭:০২:৪৫ অপরাহ্ন
জুয়েল আহমদ, এমসি কলেজ: ১৪ জুলাই ২০২৪, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা রাজাকার মন্তব্যের জের ধরে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরা বাংলাদেশ। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে রাতেই প্রতিবাদ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। সিলেটের ক্যাম্পাসগুলোও সেই প্রতিবাদে ছিলো সক্রিয়। বিশেষ করে শাবি, সিকৃবি ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ওসমানী মেডিকেল ক্যাম্পাসগুলো। যদিও সেই জায়গায় একদম চুপ ছিল এমসি কলেজ। এরই ফলশ্রুতিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচনা সমালোচনা হয় এমসি কলজেকে নিয়ে। যেকোনো আন্দোলনে সক্রিয় থাকা সিলেটের হাতেগোনা যে কয়েকটি ক্যাম্পাস আছে তাদের মধ্যে এমসি কলেজ উপরের সারিতেই। যার কারণেই সিলেটের রাজনীতির আতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত এই ক্যাম্পাসটি বেশি সমালোচিত হয়। শুধু যে কোনো কর্মসূচী করতে পারেনি এমসি কলেজ এমন নয়, এমসি কলেজ থেকে হয়নি কোনো মানবন্ধনও। চুপ ছিল ক্যাম্পাসের সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে শুরু করে শিক্ষক পরিষদও। এমনকি আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এমসি কলেজ সমন্বয়ক কমিটিও দিতে পারে নি। যদিও আন্দোলনের একেবারে শেষের দিকে এসে ৩ আগষ্ট, ১৪ সদস্যের সমন্বয়ক কমিটি ঘোষণা করে সংগঠনটি। এমসি কলেজ চুপ থাকাটা কী আসলেই চুপ থাকা ছিল, নাকি ভেতরে ভেতরে সিলেটের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা ছিল এবং ঠিক কোন কারণ নিজস্ব ব্যানারে আন্দোলনে আসতে পারেনি এমসি কলেজ, তা আমরা জানতে চেয়েছিলাম এবারের পর্বে।
এই বিষয়টি জানতে প্রথমেই কথা হয় আন্দোলনে সক্রিয় থাকা এমসি কলেজ দ্বিতীয় বর্ষ পড়ুয়া শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমদ এর সাথে। তার কাছে থেকে জানতে চাওয়া হয় তিনি কীভাবে আন্দোলনে যেতেন এবং এমসি কলেজ শিক্ষার্থীরা কিভাবে আন্দোলনে যোগ দিতো সেই ব্যাপারে। তিনি জানান, আমার মূলত সমন্বয়কহীনতায় ছিলাম। যার কারণে একসাথে নিজেরা কিছু করতে পারতাম না। আমরা সবসময় শাবি সমন্বয়কদের নির্দেশনা ফলো করতাম। নিজেদের ক্যাম্পাসে অবস্থান না নিয়ে আমার ডিরেক্ট শাবিতে চলে যেতাম। একজন যাওয়ার সময় চেষ্টা করতাম আরেকজনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এরকম করে প্রত্যেকেই উপস্থিত হতো মূল স্পটে। মজার ব্যাপার, আন্দোলনের মূল স্পটে গিয়ে দেখতাম ক্যাম্পাসের অনেক সিনিয়র জুনিয়র। যেটার উপস্থিতি অন্য ক্যাম্পাসের তুলনায় যথেষ্ট বড়ই থাকতো। তারপরও আমরা এক হওয়ার সাহস বা শক্তি পেতাম না। অনেকে এতোটাই আতঙ্কে থাকতো যে, মুখে মাস্ক পরে আন্দোলনে আসতো। কেউ কেউ আবার মিডিয়া থেকে দূরে থাকতো। এতো আতঙ্কের মূল কারণটা কী ছিল? জানতে চাওয়া হলে জুবায়ের জানান, আতঙ্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ছাত্রলীগ। তারা এমসি কলেজ থেকে কারা আন্দোলনে যাচ্ছে তা টার্গেট করতো। বাসা খুঁজতো, বাসায় গিয়ে হুমকি দিতো। রাস্তায় পেলে হত্যার হুমকি দিতো। ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকিও দিতো।
এ অভিযোগগুলো নিয়ে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এমসি কলেজের বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার সাথে যোগাযোগ করা হয়। জানতে চাওয়া হয় তারা কীভাবে পরিকল্পনা করতো এবং কারা নেতৃত্ব দিতো এই সকল তালিকা ও হুমকি প্রদানে। তাদের ভাষ্যমতে, তালিকা মূলত বন্ধবান্ধব থেকে সংগ্রহ করা হতো। ছাত্রলীগ কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হতো যে, তাদের পরিচিত বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র, জুনিয়র যদি কেউ আন্দোলনে যায় তাহলে তাদের তথ্য দেওয়ার জন্য। আর এগুলোর পেছনে মূল কলকাঠি নাড়তেন ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নাজমুল ইসলাম ও সরকারী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহেল আহমদ। উভয়েই বহিরাগত হলেও এমসি কলেজ কেন্দ্রিক তাদের আগ্রহ ছিল প্রচুর। তাদের ক্যাম্পাসের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিয়ে সহযোগিতা করতেন, এমসি কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক টেলেন্ট কান্তি দাশ। মেসেঞ্জার গ্রুপে আদান প্রদান হতো ফেইসবুক আইডি লিংকসহ ব্যক্তিগত অনেক তথ্য।
অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল ও রুহেলের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে হুমকি প্রদানের। বাসায় গিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের না পেলে শাসানো হতো তাদের পরিবারকে। যার ফলে আতঙ্কিত থাকতে হতো আন্দোলনকারীসহ তার পরিবারকেও।
ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের ভাষ্যমতে, তাদের নেতারা মনে করতেন, টিলাগড় হলো ছাত্রলীগ ও তাদের স্বপক্ষের শিক্ষার্থীদের আখড়া। কাজেই এখানে কোনো শিক্ষার্থীকে মিছিল মিটিং করতে দেওয়া হবে না। এই ব্যাপারে আবার প্রকাশ্য ফেইসবুক পোস্টে হুমকিও দিতেন তারা। যদিও এখন এসব পোস্ট ডিলেইট করে দিয়েছেন সেইসব নেতাকর্মী। এতোকিছুর পরও যে এমসি কলেজের শিক্ষার্থীরা গোপনে অন্য ক্যাম্পাসে আন্দোলন করছিল তা কিন্তু নয়। শিক্ষার্থীরা একটি মানবন্ধনের ডাকও দেয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটি ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নাজুমল ইসলামের কানে পৌঁছায়। তিনি টিলাগড় গ্রুপ নামক একটি মেসেঞ্জার গ্রুপে সকল নেতাকর্মী এমসি কলেজে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেন। নির্দেশ অনুযায়ী নেতা কর্মীরা সেদিন সকাল ৭.৩০ থেকে সেখানে অবস্থান নেয়। সেই সময় ছাত্রলীগের কর্মীদের সাথে অস্ত্রসহ বহিরাগতরাও ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীরা বিষয়গুলো টের পাওয়াতে সেদিন কর্মসূচী প্রত্যাহার হয়। ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষার্থী না পেয়ে ছাত্রলীগের এমসি কলেজ সভাপতি দেলওয়ার হোসাইন রাহী একটি মন্তব্যও করেন ফেইসবুকে। সেখানে কয়েকটি শেয়ালের ছবি দিয়ে তিনি লিখেন, ভোর সকালে এসে কয়েকটি শেয়ালের দেখা পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু কোনো আন্দোলনকারীকে পাওয়া যায়নি ।
আরো বেশ কিছু শিক্ষার্থীর সাথে বিস্তারিত আলাপ হয়। শাবিপ্রবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ উপেক্ষা করতে পারলেও এমসি কলেজ শিক্ষার্থীরা না পারার পেছনে মূল চ্যালেঞ্জগুলো কী ছিল তা জানতে চাওয়া হয়। তাদের সবারই মোটামুটি কয়েকটি জায়গায় বেশ মিল ছিল। তারা জানান যে, সিলেটের অন্য পাবলিক কিংবা প্রাইভেট ক্যাম্পাসের মতো এমসিতে এতোটা ইউনিটি বা উপস্থিতি নেই। যার কারণে একজন শিক্ষার্থী হুমকির মুখে পড়লে অন্য কাউকে পাশে পাওয়া দুষ্কর ছিল। এমসি কলেজ স্বায়ত্বশাসিত কোনো প্রতিষ্ঠান না হওয়াতে শিক্ষকরাও ছিলেন একপ্রকার জিম্মি। অন্য ক্যাম্পাসের রাজনীতি ছিল ক্যাম্পাস কেন্দ্রীক। কিন্তু এমসি কলেজের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সেখানে টিলাগড় থেকে শুরু করে অন্য অঞ্চলগুলোর বহিরাগত নেতাকর্মীদের নিয়েই রাজনীতি চলতো এমসি কলেজে। যার কারণে চ্যালেঞ্জটাও ছিল বেশ কঠিন।
এত কিছুর পরও কোন জায়গাটিতে কিংবা কোন সময়টাতে এমসি কলেজ শিক্ষার্থীরা ভূমিকা রেখেছিল তা স্পষ্টতই জানতে চাওয়া হলে সোহান নামের এক শিক্ষার্থী জানান, আমরা কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকে একেবারে গনঅভ্যুত্থান পর্যন্ত সবকটি দিন নিজেদের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছি। নিজেদের ক্যাম্পাসের নামটাকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে আন্দোলনটাকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় তাতে জোর দিয়েছিলাম। এর সবই ছিল ব্যক্তি উদ্যোগে। আমাদের সহযোদ্ধা অনেকে গুলি খেতেন, তারপর তারা নিজ উদ্যেগেই চিকিৎসা গ্রহণ করতেন। যে আটক হয়েছিলেন সে তার ব্যক্তি উদ্যেগেই লড়ে গেছেন আইনী প্রক্রিয়া। বিশেষত যখন সব ক্যাম্পাসের হল এবং হোস্টেল বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন অন্যান্য ক্যাম্পাসের সিলেটের বাহিরের শিক্ষার্থীরা সিলেট ছাড়েন। সেই জায়গায় এমসি কলেজ পড়ুয়া বেশিরভাগ স্থানীয় শিক্ষার্থী আন্দোলনের শক্তিটাকে আরো দ্বিগুণ করে তুলে। হাত মিলায় সিলেট বাকি ক্যাম্পাসগুলোর সাথে। আর যার ফলেই মূলত সিলেটের আন্দোলন গুলো ছিল সক্রিয় এবং ফলপ্রুসূ।
বিগত দিনের এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে কী কোনো পরিকল্পনা আছে শিক্ষার্থীদের তা জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, আমরা চাই ক্যাম্পাসে সুষ্ট ধারার রাজনীতি ফিরুক। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের জায়গাটুকু থাকুক। অতি দ্রুত ছাত্র সংসদ গঠন হোক। যাতে করে ভবিষ্যতের যেকোনো আন্দোলন, সংগ্রাম , বিপ্লবে এমসি কলেজ নিজেদের অবস্থানে থেকে তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে।