দুর্যোগে’র বৃত্তে বাংলাদেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২:৩১:৩২ অপরাহ্ন
৪ মাসে পৌনে ২ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত
জালালাবাদ রিপোর্ট : বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের বৃত্তে যেন আটকে আছে বাংলাদেশ। গত মে মাস থেকে চলতি আগস্ট পর্যন্ত চার মাসে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব দুর্যোগের মধ্যে ছিল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা। এখন আবার চলতি সেপ্টেম্বর মাসে বন্যার নতুন পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, যা নতুন দুর্যোগের আভাস দিচ্ছে।সবচেয়ে বেশি ৬০ লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যায়। তবে বিভিন্ন সংস্থা বলছে, এ বন্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮০ লাখের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এর আগে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত তিন দফা বন্যায় সিলেটের ২০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। জাতিসংঘের মানবিক-বিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক ১১ জেলায় বন্যা বিগত ৩৪ বছরে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে সবচেয়ে ভয়ংকর। আর এ বছর এখন পর্যন্ত সব দুর্যোগ মিলিয়ে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৫০ লাখ।দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ ও হিউম্যানিটারিয়ান টাস্কফোর্স টিম বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে যৌথ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বলা হয়, সর্বশেষ মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জসহ বন্যাকবলিত ১১টি জেলায় সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এসব প্রতিষ্ঠানে খাওয়ার পানির উৎস, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, পাঠদান কক্ষসহ বেশির ভাগ অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশির ভাগ স্কুলের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মানুষের জীবনধারা প্রায় অচল হয়ে যায়।
২০ আগস্ট থেকে দেশের দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্বের ১১টি জেলায় প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। এর সঙ্গে উজানের ঢল মিলে ব্যাপক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সর্বশেষ জানিয়েছে, বন্যায় ৭১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
ওসিএইচএর হিসাব অনুযায়ী, বন্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬০ লাখ। এ সংখ্যা এ বছরের অন্য যেকোনো দুর্যোগে সর্বোচ্চ। এ বছর প্রথম বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় রিমাল। গত ২৬ মে এটি উপকূলে আঘাত করে। আক্রান্ত হয় ৪৬ লাখ মানুষ।
বৃহত্তর সিলেটে মে মাসের শেষে, ১২ থেকে ১৯ জুন এবং ৪ থেকে ১১ জুলাই তিন দফায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সৃষ্টি হয় বন্যা পরিস্থিতির। তবে সব দুর্যোগ ছাপিয়ে যায় চলমান বন্যা পরিস্থিতি।
ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন :
ওসিএইচএ বা সরকারি সূত্রে চলতি বন্যা নিয়ে যেসব হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ক্ষতি সম্পর্কে সঠিক চিত্র পাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন দুর্যোগবিষয়ক বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলেন, এবারের বন্যায় কল্পনাতীত ক্ষতি হয়েছে। বন্যার ক্ষতির হিসাব তিন সপ্তাহ পর, এরপর দ্বিতীয় দফায় ১২ সপ্তাহ পর করতে হয়। তখন সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে।
বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ডিজাস্টার ফোরাম বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ করে। বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ডিজাস্টার ফোরামের সদস্যসচিব গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়িতে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ফেনীর ৬০ শতাংশ জমি বালুতে পূর্ণ হয়ে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে গেছে। মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা বিধ্বস্ত বাড়িঘর পাচ্ছে। বিস্তীর্ণ এলাকার সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে। এসবের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে।
অন্যদিকে অক্সফামের তথ্য বলছে, বন্যায় এসব জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফেনী ও নোয়াখালী জেলার ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। এছাড়া দুই জেলার পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল হয়েছে।
এবার ১১ জেলায় যে বন্যা হয়েছে, তা মূলত হঠাৎ বন্যা। এর বৈশিষ্ট্য অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপকহারে প্লাবন হয় এবং দ্রুতই পানি নেমে যায়। কিন্তু হঠাৎ ব্যাপক প্লাবন হলেও পানি নামছে খুব ধীরে।বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, অন্য সময়ের আকস্মিক বন্যার তুলনায় এবার পানি নেমে যাওয়ার হার কম।
পানি ধীরে নামার কারণ হিসেবে বন্যার শুরুতে পূর্ণিমার জন্য সাগরে অস্বাভাবিক জোয়ার, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং উপদ্রুত এলাকার নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দুর্যোগবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আবদুল লতিফ খান বলেন, যেসব এলাকায় বন্যা হয়েছে, যেমন ফেনী বা কুমিল্লার মতো এলাকাগুলো দীর্ঘকাল এ অবস্থার মুখোমুখি হয়নি। এবারের বন্যা এসব এলাকার জন্য অস্বাভাবিক, অভূতপূর্ব।
অক্সফামের প্রতিবেদন :
চলমান বন্যা নিয়ে মঙ্গলবার অক্সফাম বাংলাদেশ প্রকাশিত জরুরি চাহিদা নিরূপণ প্রতিবেদন বলা হয়েছে, চলমান বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করায় বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর ক্ষতচিহ্ন ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দুর্গতদের মধ্যে জীবিকা হারানো ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ৭২ শতাংশ প্রতিদিন এক বেলা খেতে পারছে, যা পর্যাপ্ত নয়। পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় খোলা জায়গায় মলত্যাগ বাড়ছে, যা ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এসব রোগে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছে।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার বন্যাদুর্গত হোসনে আরা (৩৮) নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, বন্যার সময় পরিবার নিয়ে আমরা ছাদে থাকতাম। আমাদের কাছে বিশুদ্ধ খাবার পানি বা খাবার কিছুই ছিল না। টয়লেটও ডুবে গিয়েছিল, এ ক্ষেত্রে মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত সম্ভব হতো না। আমরা কেবল রাতের বেলা শাড়ি দিয়ে ঘিরে টয়লেটের কাজ সারতাম। অনেকেই অসুস্থ হয়ে যেত। এ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। এই বন্যা আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।
ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর আবদুল করিম (৫২) জীবিকা ও ঘরবাড়ি সব হারিয়েছেন। হোসনে আরার মতো আবদুল করিমও বন্যায় পরিবার নিয়ে ঘরের ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর ছোট একটি সবজির দোকান ছিল, যা তার পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস, সেটি নষ্ট হয়ে গেছে বন্যায়। এখন সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে তাঁকে।
অক্সফামের কান্ট্রি ডিরেক্টর আশিষ দামলে বাংলাদেশের বন্যা সম্পর্কে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি। বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি ডুবে গেছে। জীবিকা হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি, দুর্গত জনগোষ্ঠীকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই বন্যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ১১ জেলার বিশাল অংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। বাস্তুচ্যুত হয় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ। এই বন্যায় প্রায় ৬০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অবকাঠামো, বাড়িঘর, কৃষি ও মৎস্য খাত।